জুবায়ের আহমেদ
এক সময় সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শ লিপি’ বাঙালি শিশুর প্রথম বই হলেও, এখন বাজারে এমন বই ভুরি ভুরি। বেশিরভাগের প্রচ্ছদেই থাকে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা কার্টুন, না হয় কোনও বিদেশি শিশুর ফটোগ্রাফ। বর্ণমালার বইতে চাকচিক্য আনতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি সংস্কৃতি ও শিল্পবোধ। এ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন সচেতন মহল ও শিক্ষাবিদরা।
রাস্তার ধারে, গণপরিবহনে কিংবা ফুটওভারব্রিজের ওপর এসব বই বিক্রি করতে দেখা যায়। পরিচিত কার্টুনের ছবি থাকে বলে চলেও বেশ। ভেতরের মান যেমনই হোক, শিশুর হাতে কোনোমতে একটা আদর্শ লিপি ধরিয়ে দিতে পারলেই অনেক অভিভাবক মনে করছেন তাদের দায়িত্ব শেষ।
মিরপুরে এ ধরনের বই বিক্রেতা হানিফ জানান, দিনে নানা ধরনের আদর্শ লিপির প্রায় শ’ খানেক বিক্রি করেন তিনি। ১৫-২০ টাকা করে। বিদেশি কার্টুনওয়ালা আদর্শ লিপির চাহিদাই বেশি।
প্রশ্ন ওঠে, বইগুলোর মান কেমন? কয়েকটি বই দেখতেই পরিষ্কার হলো, দেশে বর্ণমালা শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে যেন বসে আছে ভারতীয় ও আমেরিকান কিছু কমিকস হিরো। বইয়ের নামও তেমন-‘মোটু পাতলুর হরেক রকম পড়া’, ‘ডোরেমনের আদর্শ লিপি’। আরও আছে আধুনিক বাল্যশিক্ষা, মায়ের কাছে লেখাপড়া এসব নামের বই। কিন্তু নামের সঙ্গে মিল নেই প্রচ্ছদের। সবকটাতেই বিদেশি শিশুর ছবি।
শিশু সাহিত্যিক ও ছড়াকার জনি হোসেন বলেন, “বইগুলোতে ছন্দে ছন্দে যে বর্ণ বা শব্দ পরিচয় দেওয়া আছে—সেখানে ছন্দের মাত্রাগত ত্রুটি আছে। অন্ত্যমিলও ঠিক নেই। একটা ছড়ার লাইন এমন—Mango হলো ফলের রাজা, Nest অর্থ পাখির বাসা। ‘রাজা’র সঙ্গে এখানে জোর করে ‘বাসা’ মেলানো হয়েছে। ভুল বানানের ছড়াছড়ি তো আছেই। যেমন—‘বেশি’ বানানটি লেখা হয়েছে ‘বেশী, ‘হলো’ বানানটি লেখা হয়েছে ‘হল’, ‘রানি’কে লেখা হয়েছে ‘রানী’।”
তিনি আরও বলেন, “ছন্দে ছন্দে যে কথাগুলো বলা হয়েছে সেগুলো শিশুবান্ধবও নয়। যেমন একটা বইতে দেখলাম—‘Gun দিয়ে শিকার ধরি’। এসব বইতে এ ধরনের বাক্য একদমই মেনে নেওয়া যায় না। অভিভাবকদেরও সতর্ক হতে হবে। আদরের সন্তানের হাতে প্রথম পাঠ হিসেবে তারা যেন দেখেশুনে শুদ্ধ বই নির্বাচন করেন।”
প্রচ্ছদ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘বইতে মোটু-পাতলু, ডোরেমনসহ টিভি সিরিজের জনপ্রিয় চরিত্রগুলো ব্যবহার করায় একটা বড় সমস্যা হবে। সেটি হচ্ছে, বই নিয়ে বসলেই শিশুদের ওই চরিত্রগুলোর কথা মনে পড়ে যাবে। তখন তাদের মনোযোগ চলে যাবে টিভিতে।’
তার পরামর্শ হলো—অন্তত এ ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। বা এগিয়ে আসতে হবে বড় প্রকাশকদের। তারা নামকরা ছড়াকারের মাধ্যমে লেখাগুলো লিখিয়ে নিতে পারেন। আর অবশ্যই শিশুদের মননশীলতার কথা চিন্তা করে দেশীয় আমেজে আঁকতে হবে প্রচ্ছদ। শব্দ বাছাইয়েও সতর্ক হতে হবে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘শিশুদের বইয়ের লেখা কিংবা অনান্য উপাদান আমাদের সমাজ, সংস্কৃতিকে লক্ষ্য করে করা উচিৎ। শিশুর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে যায় না, এমন কিছুর ব্যবহার করা হলে সেটা ভালো প্রভাব ফেলবে না। জটিল শব্দ ও বাক্যও তাদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এর প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘বইগুলো ন্যাশনাল কারিকুলাম অনুযায়ী ছাপানো হয় না। অসচেতন অভিভাবকরা শিশুদের হাতে বইগুলো তুলে দিচ্ছেন। যারা ছাপাচ্ছে তারা ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে কাজটা করছে। এসব কারা করে জানা নেই। তবে আমি মনে করি এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিত।’
এ ব্যাপারে শাস্তির বিধান রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেই অর্থে নেই। কিন্তু আমাদের যে কারিকুলাম রয়েছে সে অনুযায়ী লিখতে হবে। আমাদের কাছ থেকে অনুমোদনও নিতে হবে। এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। পথেঘাটের বইগুলোর বিষয়ে প্রশাসন পদক্ষেপ নিতে পারে।’
রিয়াজুল হাসান আরও বলেন, ‘সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক রয়েছে। যাদের বয়স ৬ বছরের নিচে ও ৫ বছরের বেশি, তারা সেখানে আড়াই ঘণ্টা ক্লাস করে। তাদের একটা ওয়ার্কবুক আছে। তাতে শিশুরা আঁকিবুঁকি করে। সেগুলো অবশ্য স্কুলের বাইরে নিতে পারে না শিশুরা। আবার ৫ বছরের নিচে ও ৪ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য আরেকটি শিক্ষা কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে।’
Discussion about this post