সাত বছরের সন্তানকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল সালমা আলীর। কিন্তু যে চিকিৎসকের কাছে সন্তানকে নিয়ে যেতেন, করোনা আতঙ্কের পর তিনি প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ করে দেন। আর তখনই সালমা আলী কল করেন করোনা হেল্প ডেস্কে। সাত বছরের নাহিয়ানের সমস্যা শুনে মোবাইল ফোনেই তার চিকিৎসা দেন চিকিৎসক। আর এভাবেই ঘরে থাকা মানুষদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান, ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করছে করোনা ‘হেল্প ডেস্ক’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কেন এ ভাবনার জন্ম হলো জানতে চাইলে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট ডা. শেখ মইনুল ইসলাম খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পৃথিবীজুড়েই এখন একটি কথা–বাসায় থাকতে হবে, কোয়ারেন্টিনে থাকবে হবে। কিন্তু যারা বাসায় থাকছেন তারাও তো নানান ধরনের সিজনাল ফ্লুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কারও এতদিনের নির্ধারিত চিকিৎসক এখন আর চেম্বারে বসছেন না, তাদের পরামর্শ দেওয়া, তাদের বাসায় ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজের জন্যই করোনা হেল্প ডেস্ক কাজ করছে। গত ২১ মার্চ শুরু হওয়া করোনা হেল্প ডেস্ক থেকে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি মানুষ সার্ভিস নিয়েছে বলেও জানান তিনি। ডা. শেখ মইনুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘এখন তো খুব আতঙ্ক কাজ করে একটু কাশি, শ্বাসকষ্ট বা জ্বর হলেই। ভয়ে অনেকে চলে যাচ্ছেন হাসপাতালে, কিন্তু হাসপাতালে তো সবার যাওয়ার দরকার নেই। তাই আমরা বলছি, আপনি বাসায় থাকেন, সমস্যা হলে আমাদের জানান-আমাদের ডাক্তার সমস্যার কথা শুনে ওষুধ দেবেন। আর প্রয়োজন হলে তারাই পরামর্শ দেবেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।-এই কাজগুলো করা হচ্ছে করোনা হেল্প ডেস্ক নামের একটি গ্রুপ থেকে, আর এই কাজের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের ১১১ জন চিকিৎক যুক্ত আছেন। তারা সার্ভিস দিচ্ছেন হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভার, ইমো এমনকি স্কাইপেতেও। আর এর মাদার সংগঠন হিউম্যান এইড বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।
ডা. শেখ মইনুল ইসলাম খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পরামর্শ দিচ্ছেন সব চিকিৎসকরা, কিন্তু বাসায় ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার জন্য লোক দরকার হলে একজন ভলান্টিয়ার সে দায়িত্ব নিচ্ছেন। তিনি ফার্মেসি থেকে সঠিক ওষুধ কিনে অসুস্থের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসেন। সেখানে ওষুধের দামটা ওই বাসা থেকে পরিশোধ করা হয়। কারণ, ওষুধ কিনে দেওয়ার সামর্থ তো আমাদের নেই। সাধারণ মনে হলেও এই সার্ভিসটাই এখন এত বেশি দিতে হচ্ছে যে তিনজন বাইকার এখন শুধু এই ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। আর গ্লোবাল ওয়ান নামের একটি এনজিও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে, যেটি আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত এই সংগঠনের সঙ্গে থাকবে।
ডা. শেখ মইনুল ইসলাম খোকন আরও বলেন, করোনাভাইরাসের এই সংকটের সময় বিভিন্ন হাসপাতালে এখন চিকিৎসকরা দিন-রাত এক করে কাজ করেছেন। সেবা দিচ্ছেন বটে তবে তাদেরও নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবারের সমস্যাটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে ডা. সোহানুর রহমান আমাদের একটা বিশেষ পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য খাবার সরবরাহ শুরু করি আমরা।
তিনি বলেন, গত ২৭ মার্চ রাতে প্রথমদিনের খাবার দেওয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের। সেই শুরু, তারপর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, বিমানবন্দরে ডিউটি করা চিকিৎসকদের, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েতমৈত্রী হাসপাতাল, ধানমন্ডিতে অবস্থিত উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন হাসপাতাল, নর্দান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম, গ্রিনলাইফ হাসপাতালের চিকিৎসকদেরকে খাবার সরবরাহ করে যাচ্ছে এই সংগঠন। চিকিৎসকরা কেবল লাঞ্চ প্রতি ৮০ টাকা করে দিচ্ছেন, এই টাকাটা যাচ্ছে হিউম্যান এইডের করোনা নামক ফান্ডে।
ডা. শেখ মইনুল ইসলাম খোকন আরও জানান, কেবল তাই নয়, মিরপুরের টোলারবাগ যখন লকডাউন করে রাখা হয়, তখন সেখানে বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দেওয়ার কাজটাও তাদের সংগঠনট। গত ২৭ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত টোলারবাগের ওই এলাকাতে সাড়ে তিন হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে কল্যাণপুর বস্তিতে হিউম্যান এইডের একটি স্কুল রয়েছে, সেখানে একটি হেলথ কেয়ার সেন্টার এবং কোয়ারেন্টিন সেন্টার করা হবে―যেন বস্তির মানুষদের বস্তির বাইরে না যেতে হয়, বলেন তিনি।
প্রতি ঘণ্টায় ৪০টির বেশি ফোন কল পেয়ে কাজ করে যাচ্ছে করোনা হেল্প ডেস্ক জানিয়ে তিনি বলেন, বিশেষ পরিস্থিতে ঘোষিত হওয়া সাধারণ ছুটিতে যারা বিপদে পড়েছেন এবং করোনায় যেন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন না হয় সেজন্য যে যেখানে আছেন সেখানে থেকে কেবল আমাদের জানালে প্রয়োজনীয় সার্ভিস দেওয়া হবে।
’আমরা তরুণ, কাজ করার আগ্রহ আছে, কাজটা করতে চাই। কেবল চাই সবার সহযোগিতা’, বলেন ডা. শেখ মইনুল ইসলাম খোকন।
এদিকে, জুনিয়র চিকিৎসকদের সাহায্য করতে ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ গঠন করেছেন চারজন চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে আছেন আরও তিন জন।
ডা. মাঈদুল হাসান শিপন, ডা, প্রসেনজিত কুমার কুন্ডু অনিক, ডা. জুলকার নাঈন অনিক ও ডা. সাখাওয়াত নাদির এই রেসপন্স টিম মূলত তরুণ চিকিৎসকদের সাহায্য করার জন্যই।
ডা. মাঈদুল হাসান বলেন, তাদের এ উদ্যোগ মূলত জুনিয়র চিকিৎসকদের জন্য। কারণ, তারা হাসপাতালগুলোতে বিশেষ পরিস্থিতিতে কাজ করতে গিয়ে অসহায় বোধ করে―তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এ উদ্যোগ। কী ধরনের অসহায়ত্ব জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেসরকারি হাসাপাতালগুলোতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়ার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভীষণ অনীহা, যদি দেওয়া হয়ও সেগুলো চলে যায় সিনিয়র চিকিৎসকদের কাছে―আর এ পরিস্থিতিতে জুনিয়ররা না পারেন বলতে, না পারেন সইতে। এ কারণে তাদেরকে মূলত সাহায্য করার জন্যই এ উদ্যোগ, বলেন ডা. শিপন।
তিনি বলেন, তরুণ চিকিৎসকরা হাসপাতালগুলোতে ডিউটি ডাক্তার হিসেবে কাজ করেন, তাদের বেশিরভাগই হোস্টেল বা মেসে থাকে। কিন্তু এদের যদি কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন, তাহলে তারা না যেতে পারবেন হোস্টেলে, না যেতে পারবেন বাড়ি-কেউ তাকে সহজে গ্রহণ করবেও না। ফলে এ সংকট এড়াতে এসব তরুণ চিকিৎকের জন্য একটি ডেডিকেটেড ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। যেখানে কল করলে তার পুরো বিষয়টা আমরা দেখভাল করবো―যেমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, চিকিৎসা করানোসহ সবকিছু।
গত ২৮ মার্চ থেকে মূলত চারজন চিকিৎসক মিলে এই কাজটা শুরু করেছেন। চারজন চিকিৎসকদের সঙ্গে এ গ্রুপে মেডিক্যাল পেশার সঙ্গে জড়িত নন এমন তিন জন হচ্ছেন , নুসরাত নুর শাওন, কাজী আমিনুল ইসলাম ও অলিভ হাসান। তারা মূলত লজিস্টিক সাপোর্ট যেমন পিপিই, এন-৯৫ মাস্ক, গ্লাভস দিয়ে সাহায্য করছেন, জানিয়েছেন ডা. হাসান।
Discussion about this post