রা’আদ রহমান
সেদিন শীতের সকালে ছেলে ছোট্ট সুমন জাহিদকে গোসল করানোর জন্য শরীরে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। চুলায় রান্না চড়ানো, দরজায় হাজির হলো ওরা। শাড়িটাও বদলাতে দেয়নি, ওই মুহূর্তে এই অবস্থাতেই যাওয়ার আগে ছেলে সুমনের মাথায় হাত বুলিয়ে মা শুধু এতোটুকু বলেছিলেন, ‘সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসব।’ সেলিনা পারভীন আর ফেরেননি।
ললনার পাশাপাশি তিনি সাপ্তাহিক বেগমেও কাজ করতেন। অনেক সময় বেতন বলতে তেমন কিছুই পেতেন না তিনি। কিন্তু ললনার বিজ্ঞাপন বিভাগে বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ তৈরি, টাকা-পয়সা সংগ্রহ করার জটিল কাজটা নিরবিচ্ছিন্নভাবে করে গেছেন তিনি। এর পাশাপাশি দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ইত্যাদি অনেকগুলো পত্রিকাতেই নিয়মিত লিখতেন। এভাবেই সংবাদ সংগ্রহ ও লেখালেখি পেশার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকার ফলে একটা সময়ে নিজের একটা পত্রিকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে জন্ম দেন তৎকালীন অন্যতম সাড়া জাগানো পত্রিকা ‘শিলালিপি’র।
কিন্তু এর ফলেই তিনি চোখে পড়ে গিয়েছিলেন রাজাকার আলবদরদের। শিলালিপি ছিল তার সন্তানের মতো। একাত্তরে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব শুরু হলো, তখন তার সন্তানসম এই শিলালিপিকেই তিনি পরিণত করলেন এক অনবদ্য অস্ত্রে। পাকিস্তানিদের নিষেধাজ্ঞা আর নানাবিধ হুমকিধমকিতে ললনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো, সেলিনা তারপরেও দমলেন না। তার বাসাটা পরিণত হলো মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল এবং রসদ প্রাপ্তির নির্ভরযোগ্য জায়গায়। প্রায়ই গভীর রাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তার বাসায় আসতেন, খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে যাওয়ার আগে সেলিনা পারভীন তাদের নানাভাবে নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করা ঔষধ, কাপড় আর নগদ অর্থ দিয়ে দিতেন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ যা কিছু অর্থ আসতো— প্রায় সবটাই তিনি ব্যয় করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ফলে একটা সময়ে তিনি আলবদরদের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে যান। তাকে আলাদাভাবে টার্গেট করে রাজাকারেরা। মায়ের সেই অসম যুদ্ধ নিয়ে সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বলেছিলেন সেলিনা পারভীনের সন্তান সুমন জাহিদ। তার জবানীতে শোনা যাক সেইদিনগুলোর কথা—
রাজধানী ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকার ১১৫, নিউ সার্কুলার রোড। এ বাড়ি থেকেই ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনকে আল বদর বাহিনীর জল্লাদরা তুলে নিয়ে যায়/ ছবি কৃতজ্ঞতা: গেরিলা ৭১
তাই সেলিনা আগস্ট-সেপ্টেম্বরে শিলালিপির যে সংখ্যাটি বের করলেন, সেটায় নিয়মিত প্রচ্ছদ না দিয়ে তার ভাইয়ের ছেলেদের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ সাজানো হলো। যেন পাকিস্তানিরা সন্দেহ না করে। কিন্তু তার আগে যে সংখ্যাটা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটার জন্য বহু আগেই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানি ও আলবদরদের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ সেই সংখ্যাটায় ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সাহায্য দেওয়াসহ তার নানাবিধ কর্মকাণ্ড এমনিতেই যথেষ্ট ছিল— তার উপর ওই সংখ্যাটিতে প্রকাশিত বারুদে লেখাগুলো সেলিনাকে পরিণত করেছিল পাকিস্তানিদের টার্গেটে। তাই আরেকটি সংখ্যা বের হওয়ার আগেই ১৩ ডিসেম্বর চিরতরে হারিয়ে গেলেন সেলিনা।
সেদিনের পর মা সেলিনা পারভীনের সঙ্গে আসলে কী হয়েছিল, কিভাবে তাকে মেরে ফেলা হলো— সেটা জানতে দীর্ঘ ৩৫ বছর সময় লেগেছে ছেলে সুমন জাহিদের। এক সাক্ষাৎকারে তিনি অবশেষে জানিয়েছিলেন সেই রোমহর্ষক ঘটনাবলি। একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন সেলিনা পারভীনের সঙ্গে। তার নাম ছিল দেলোয়ার হোসেন। দেলোয়ার— সুমন জাহিদের কাছে সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সেলিনার জন্যই তিনি (দেলোয়ার) বেঁচে যান, তাকে মেরে ফেলার সময় পেছন থেকে হাত ছুটিয়ে চোখ খুলে সেই মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সেই প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধাই জাহিদকে জানিয়েছিলেন, সেলিনা পারভীনকে আরও অনেক বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়ে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের টর্চার সেলে রাখা হয়েছিল। সেখানে তাদের খেতে দেওয়া হয়নি, বসতে দেওয়া হয়নি এবং প্রাকৃতিক কাজ সারারও কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। অবর্ণনীয় ও পৈশাচিক অত্যাচারের একপর্যায়ে আলবদর কর্মীরা ঠাণ্ডা মাথায় যে বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি করতেন, তাদের আঙ্গুল কেটে ফেলে, চোখের ডাক্তার হলে চোখ তুলে ফেলে, হার্টের ডাক্তার হলে বুকের পাঁজর ভেঙে কলিজা বের করে আনে, হার্ট উপড়ে ফেলে। এই অত্যাচারগুলো নিজের চোখে দেখেছেন মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার।
রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শেষ সময়ে যখন সেলিনা পারভীনকে দাঁড় করানো হয়, উনি টের পেলেন তাকে মেরে ফেলা হবে। বাকি পৃথিবীর সবকিছু তখন তুচ্ছ হয়ে গেল স্রেফ মাতৃহৃদয়ের সামনে। ছেলেকে আরেকবার দেখতে পাওয়া, তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারার সুযোগের জন্য আকুল হয়ে উঠলেন মা সেলিনা পারভীন। মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার সুমন জাহিদের কাছে তার স্মৃতিচারণে বলছিলেন, সেলিনা তখন শুধু তার সন্তানের কাছে আরেকবার ফেরার জন্য ওদের অনুরোধ করেছিলেন যেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘরে তার ৮ বছরের বয়সের একটা বাচ্চা আছে, তার জন্য হলেও যেন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেলিনা জানতেন— এই অনুরোধ নিরর্থক, তবুও যদি অলৌকিক কোনো ঘটনা ঘটে, যদি কোনভাবে বেঁচে যান, আরেকটিবার তার সুমনকে দেখার সুযোগ যদি পান, আদর করার সুযোগ যদি পান। জবাবে সেলিনার মুখ বরাবর বেয়নেট চার্জ করেছিল নরপিশাচ আলবদরেরা। চিৎকার করতে করতে যখন সেলিনা পারভীন পড়ে গেলেন, পরের বেয়নেটগুলো চার্জ হলো সেলিনার বুক বরাবর। একের পর এক বেয়নেট চার্জে আলবদরেরা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে অসমসাহসী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে। শেষ পর্যন্ত টানা গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। সেলিনা পারভীনের গুলিবিদ্ধ ও ক্ষতবিক্ষত মরদেহটি পাওয়া গিয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর। খুব শীতকাতুরে ছিলেন সেলিনা, তার পায়ে তখনও পরা ছিল সাদা মোজা। সেটা দেখেই শনাক্ত করা হয়েছিল তাকে।
রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আলবদর নরপিশাচদের পৈশাচিক অত্যাচারে নিহত শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের মরদেহ। ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
লেখাটি শেষ করবো একটি প্রতিবেদনের অংশবিশেষ দিয়ে। রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের সন্ধানে গিয়ে দেখা চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি ভাষা সৈনিক অধ্যাপিকা হামিদা রহমানের দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত “কাটাসুরের বধ্যভূমি” শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন। কী অকল্পনীয় দৃশ্য দেখেছিলেন তিনি, তার কিছু অংশ জেনে নেওয়া যাক—
“কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা, জল্লাদবাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত যে, তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তার হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কাত হয়ে দেহটা পড়ে আছে। পার থেকে ধাক্কা দিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রাব্বী সাহেবের পা দুখানা তখনও জ্বলজ্বল করে তাজা মানুষের সাক্ষ্য দিচ্ছে। নাক, মুখ কিছুই অক্ষত ছিল না। দস্যু হায়েনার নখের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত…।
সামনে চেয়ে দেখি, নিচু জলাভূমির ভিতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর চোখ দুটো উপড়ানো, শূন্য কোটরে জমে আছে চাপ চাপ কালচে রক্ত। নিষ্প্রাণ পড়ে আছে দেহটা। সেখানে এক নয়, দুই নয়— একেবারে বারো/তেরোজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে, প্রত্যেকের দেহটা মোরব্বার মতো কেঁচে ফেলা হয়েছে বেয়নেট দিয়ে…। এরপর আরও একটু এগিয়ে যেতেই সামনে বড় বড় দুটো মস্ত মানুষ, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে হাত-পা বাঁধা…। আর একটু এগিয়ে যেতেই বাম হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই— কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা.. মেয়েটি সেলিনা পারভীন, সাংবাদিক, শিলালিপির এডিটর…।”
জাহিদ সুমনের সাক্ষাৎকার কৃতজ্ঞতা ও তথ্যসূত্র: https://bit.ly/37JV8YO
ছবি কৃতজ্ঞতা: গেরিলা ১৯৭১
Discussion about this post