ডা. হিমেল ঘোষ , চিকিৎসক
করোনা আক্রান্ত পুরো পৃথিবী। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিনিয়ত যোগ দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন চিকিৎসকরাও। তাই-তো তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ‘পিপিই’ ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। আজ সেই পিপিই সম্পর্কেই বিস্তারিত জানবো।
পিপিই কী: পিপিই-এর পূর্ণ রূপ হলো ‘পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট’। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম। কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো জায়গায় কাজ করেন; যেখানে তার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অথবা তিনি যদি অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ করেন, তাহলে তার জন্য পিপিই আবশ্যক।
ধরন: এটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে- তবে তা নির্ভর করে কী ধরনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পর্যাপ্ত সুরক্ষার জন্য পিপিই-তে মোট পাঁচটি উপকরণ থাকা উচিত। এগুলো হলো-
১. জুতার কভারসহ গাউন
২. গ্লাভস
৩. মুখের আবরণ (ফেস শিল্ড)
৪. চোখ ঢাকার জন্য মুখের সাথে লেগে থাকে এমন চশমা বা গগলস এবং
৫. মাস্ক।
তৈরি: পিপিই তৈরিতে এমন কাপড় ব্যবহার করতে হবে, যা কোনোভাবেই তরল শুষে নেবে না। এটি এমন পদার্থে তৈরি হওয়া উচিত, যাতে তা কোনো ধরনের তরলকে ধারণ না করে এবং সেটা গড়িয়ে পড়ে যায়। অর্থাৎ পিপিইকে সম্পূর্ণ শুষ্ক রাখবে, এমন পদার্থ ব্যবহার করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যবহার: একজন ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করে পিপিই পরতে এবং খুলতে হয়। কারণ এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অনেক সময় পিপিই দূষিত হয়ে পড়তে পারে। পিপিই যাতে অবশ্যই মুখ, নাক ও চোখ রক্ষা করে-সে ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
ইতিহাস: ১৭ শতকে ইউরোপে প্লেগ (মহামারী) দেখা দেয়। তখন ডাক্তাররা পিপিই হিসেবে অদ্ভুত রকমের একটি পোশাক পরতেন। ধারণা করা হয়, পোশাকটি ফরাসি চিকিৎসক চার্লস ডি’লরমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন ওই সময়ের ইউরোপের রাজাদের চিকিৎসক। তবে যে তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পোশাকটি বানানো হয়েছিল সেটি ভুল ছিল। তখন প্লেগ রোগের মহামারি ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
উপাদান: সে সময়ে ডাক্তাররা যে পিপিই পরতেন, তার মধ্যে ছিল একটি লম্বা কোট, যার বাইরের আবরণে মোমের প্রলেপ দেওয়া হতো। এছাড়া তারা ছাগলের চামড়ার তৈরি হ্যাট আর গ্লাভস পরতেন, চোখে থাকত চশমা। হাতে থাকত একটি লাঠি, পায়ে বুট জুতা। হাতের লাঠি দিয়ে দূর থেকেই রোগীদের শরীরে কাজ করতেন।
মাস্ক: সবচেয়ে চমকপ্রদ জিনিস ছিল তাদের মুখে পাখির ঠোঁটের মতো মাস্ক। নাকের কাছ থেকে শুরু হওয়া এই ঠোঁট ছিল আধা ফুট লম্বা। নাকের পাশে দুটি ছোট ছিদ্র ছিল নাক দিয়ে নিশ্বাসের জন্য। ঠোঁটের ভেতর পারফিউম, সুগন্ধি, ফুলসহ বিভিন্ন পদার্থ রাখা হতো। ডাক্তাররা থেরিয়াক নামে এক ধরনের ওষুধি মিশ্রণ ব্যবহার করতেন, যাতে ৫৫ ধরনের পদার্থ থাকত।
ধারণা: আবিষ্কারক ডি’লরমি ধারণা করেছিলেন, পাখির মতো ঠোঁট থাকায় এর সুগন্ধির মিশ্রণে প্লেগের দূষিত বাতাস ডাক্তারদের নাক এবং ফুসফুসে যেতে বাধা দেবে। কিন্তু এ উদ্ভট পিপিই কোনো কাজে আসেনি। কারণ মৌলিক ধারণাই ভুল ছিল। আসলে প্লেগ কোনো দূষিত বাতাসের জন্য হতো না। এর জন্য দায়ী ছিল এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়াটি ইঁদুরের ফ্লি এর কামড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে আসে।
যেভাবে বিখ্যাত: ১৭ শতকের উদ্ভট পোশাকটি পরে অনেক বিখ্যাত হয়। ইতালিয়ান অপেরা, নাটক, ফেস্টিভেলে এ অদ্ভুত মাস্কের অনেক ব্যবহার দেখা যায়। তবে এ পোশাক দিয়ে ডাক্তারদের নির্দিষ্ট করা গেলেও রোগ প্রতিরোধে কোনো কাজে আসেনি। সেদিন রক্ষা না করতে পারলেও আজকের করোনা মহামারীতে আধুনিক পিপিই কিন্তু ঠিকই চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষিত রেখে চলেছে।
Discussion about this post