অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে সীমান্তের অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে দেশপ্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে বিজিবি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার (১৯ ডিসেম্বর) বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) দিবস-২০২১ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে তিনি ভার্চ্যুয়ালি এ অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
বিজিবি সদ্যদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের কাছে আমার প্রত্যাশা, আপনারা দেশপ্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। মনে রাখবেন, শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড শৃঙ্খলা বাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। কখনও শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটাবেন না। চেইন অব কমান্ড মেনে চলবেন। কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনে চলা শৃঙ্খলা বাহিনীর অবশ্য কর্তব্য। আমার বিশ্বাস, জাতির পিতার প্রত্যাশিত আধুনিক সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হিসেবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে সীমান্তের অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে বিজিবি তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা ঐতিহ্যবাহী ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে’র গর্বিত সদস্য। এ বাহিনীর রয়েছে ২২৬ বছরের গৌরবময় ইতিহাস। ১৭৯৫ সালে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন নামে প্রতিষ্ঠার পর হতে কালের পরিক্রমায় এ বাহিনী আজ একটি সুসংগঠিত সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম প্রহরেই এ বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধে নামেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পিলখানা থেকে তৎকালীন ইপিআরের বেতার কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেন। তৎকালীন ইপিআর প্রচার করায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ দেন ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলী। ইপিআরের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বাঙালি সৈনিক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং ৮১৭ জন শাহাদত বরণ করেন। ইপিআরের দু’জন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নুর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ আমাদের গর্বের প্রতীক। ইপিআরের আটজন বীর উত্তম, ৩২ জন বীর বিক্রম এবং ৭৭ জন বীর প্রতীক মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করে বিজিবির ইতিহাস সমৃদ্ধ করেছেন। আমি তাদের সবার অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আমরা সরকার গঠনের ১ মাস ১৯ দিনের মাথায় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরে (বিজিবির আগের নাম) অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। যা দ্রুত সমাধান করি। তৎকালীন বিডিআরের ট্র্যাজিক ঘটনায় শহীদ ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ সব শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ইতিহাসের ওই কলঙ্কজনক ঘটনায় নিহত সবার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জানাই।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ০৩ মার্চ তৎকালীন ইপিআর -এর পরিবর্তে বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) নামকরণ করেন। জাতির পিতা ১৯৭৩ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানায় বিডিআরের প্রথম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। তিনি এ বাহিনীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে অনেক কার্যক্রম হাতে নেন। আমরা ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ আইন-২০১০ পাশের পর এ বাহিনীকে পুনর্গঠন করি। ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’কে একটি যুগোপযোগী ও আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। এ বাহিনীকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে সমগ্র বাংলাদেশের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা পুনর্বিন্যাস করে পাঁচজন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচটি রিজিয়নে বিভক্ত করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে আধুনিক সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হিসেবে রূপান্তরের জন্য ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১’ এর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ ৯২ হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা এরই মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে বিজিবির কার্যক্রম আগের চেয়ে বহুলাংশে বাড়ায় একটি স্বতন্ত্র এয়ার উইং সৃজনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে কেনা ০২টি অত্যাধুনিক Mi-171E হেলিকপ্টার সংযোজনের মাধ্যমে এ বাহিনীকে একটি ‘ত্রিমাত্রিক বাহিনী’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। বিজিবি এখন জল, স্থল ও আকাশ পথে দায়িত্ব পালনে সক্ষম। এ বাহিনীকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে এবং দেশের সীমান্ত এলাকায় নিশ্ছিদ্র নজরদারি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তে স্মার্ট ডিজিটাল সার্ভেইল্যান্স অ্যান্ড ট্যাকটিকাল রেসপন্স সিস্টেম স্থাপন ও সম্প্রসারণ করি। বিজিবির সাংগঠনিক কাঠামোতে ১২টি আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), ২৪৭টি All Terrain Vehicle (ATV), ১০টি রায়ট কন্ট্রোল ভেহিক্যাল, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন সিরিজের ১২টি হাইস্পিড বোট, ০২টি ভেহিক্যাল এক্সরে স্ক্যানার মেশিন কেনা হয়েছে। এছাড়াও ১৪টি আধুনিক ও যুগোপযোগী এন্টি ট্যাংক গাইডেড উইপন্স কেনা হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সাল হতে অদ্যাবধি বিজিবিতে ০৯টি নিয়মিত ব্যাচের সঙ্গে সর্বমোট ৮১৮ জন নারী সৈনিক ভর্তি করা হয়েছে। তারা সফলভাবে তাদের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ইউনিটে যোগদান করেছেন এবং পুরুষ সৈনিকের পাশাপাশি নারী সৈনিক হিসেবে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করছেন। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে এরই মধ্যে ০৪টি ব্যাটালিয়ন এবং সুন্দরবন এলাকায় ০২টি ভাসমান বিওপিসহ মোট ৬২টি বিওপি সৃজনের মাধ্যমে সীমান্ত নজরদারীর আওতায় আনা হয়েছে। ২৪২টি নতুন বিওপি সৃজন এবং ১২৬টি বিওপি সীমান্তের কাছে স্থানান্তরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পেশাদার বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজিবির ০১টি মাত্র ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজ রয়েছে, যা বায়তুল ইজ্জত, চট্টগ্রামে অবস্থিত। চুয়াডাঙ্গা জেলায় নতুনভাবে আরও একটি ‘বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজ’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি, যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষাসহ চোরাচালান, মাদক পাচার ও নারী-শিশু পাচার রোধে আপনাদের সফলতা প্রশংসনীয়। বিগত ০১ বছরে বিজিবির অভিযানে প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা মূল্যের মাদক এবং ৬০০ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকার চোরাই পণ্য জব্দ করা সম্ভব হয়েছে।
বিজিবি সদর দপ্তর পিলখানায় অনুষ্ঠিত এ অনুষষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিজিবি দিবস উপলক্ষে আটজন বিজিবি কর্মকর্তার হাতে পদক তুলে দেন।
Discussion about this post