দেলওয়ার হোসেন
কর্মসম্পাদনে গতিশীলতা ও মানসম্মত জনসেবা নিশ্চিত করতে ‘জনপ্রশাসনে পদায়ন নীতিমালা’র নতুন খসড়া তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বর্তমানে মন্ত্রণালয় থেকে বদলি বা পদায়নের আদেশ জারি হওয়ার পরও অনেক কর্মকর্তা তা মানছেন না। প্রশাসনের শীর্ষপদ সচিব পদেও পদোন্নতির জন্য ডিও দেওয়া হচ্ছে। আগের কর্মস্থলে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরও জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পাচ্ছেন। সময়মতো অবমুক্ত হচ্ছেন না। সম্প্রতি জনপ্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক অবমুক্তকরণের আদেশও দেওয়া হয়েছে। এ জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে নতুন নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রশাসনের প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিয়মের আওতায় আনা হবে।
নতুন নীতিমালায় বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রে তদবির ও প্রভাব বিস্তারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। প্রয়োজনে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কর্মচারীর ডোসিয়ারে নেতিবাচক বিষয় হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে। জনপ্রশাসনে পদায়ন নীতিমালার নতুন খসড়াটি শিগগির আরও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত করে প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। এ নীতিমালাটির চূড়ান্ত অনুমোদন হলে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন নীতিমালা-২০১৫ এবং জেলা প্রশাসক, অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং মহানগর হাকিম হিসেবে কর্মকর্তা নির্বাচন বা পদায়নের নীতিমালা-১৯৯৭ রহিত হয়ে যাবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে বদলি বা পদায়নের আদেশ জারি হওয়ার পরও অনেক কর্মকর্তা তা মানছেন না। বদলির আদেশ অমান্য করায় সম্প্রতি কয়েকজন কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কর্মকর্তার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বদলি আদেশ বাতিল করা হয়েছে। এই নীতিমালা চূড়ান্ত হলে কর্মকর্তাদের নিয়মের মধ্যে আনা সহজ হবে।
জনপ্রশাসনের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়নের জন্য একীভূত কোনো পদায়ন নীতিমালা ছিল না। শুধু মাঠ প্রশাসনের কয়েকটি পদের জন্য ছোট একটি মাঠ প্রশাসন পদায়ন নীতিমালা ছিল। ফলে প্রচলিত নিয়ম বা বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হতো। খসড়া পদায়ন নীতিমালায় প্রতিটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। নতুন অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তবে এটি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে আরও পরিবর্তন আসতে পারে।
ইউএনও, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার পদে পদায়নের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) এবং সমগ্র চাকরি জীবনের শৃঙ্খলাজনিত প্রতিবেদন সন্তোষজনক হতে হবে। পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের এসিআরের গড় নম্বর নূ্যনতম ৮০ শতাংশ হতে হবে। চাকরিকালের সততা ও সুনাম গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। যেসব ডিসি-ইউএনওর এলাকায় সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা নেই তাদের প্রত্যাহার করা যাবে। পদায়নের আগে কর্মকর্তাদের তালিকা (ফিটলিস্ট) প্রণয়ন করতে হবে। বিশেষ কারণ ছাড়া ইউএনওর কর্মকাল হবে দুই বছর, তবে একাধিক কর্মস্থলে কর্মকাল হবে তিন বছর। ডিসির ক্ষেত্রে দুটির বেশি জেলায় দায়িত্ব পালন করা যাবে না, কর্মকাল হবে মোট তিন বছর। বিভাগীয় কমিশনারের কর্মকাল হবে দুই বছর। চাকরি স্থায়ীকরণ এবং মাঠ প্রশাসনে চাকরি ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর কোনো কর্মচারীকে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) বা সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে। কোনো কর্মচারীকে একই জেলায় একাধিকবার পদায়ন করা যাবে না। উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মরত পদে নূ্যনতম চাকরিকালের শর্ত শিথিল করা যাবে। নিজের বা স্বামী-স্ত্রীর ও সন্তানের দুরারোগ্য ব্যাধির সুষ্ঠু চিকিৎসার স্বার্থে সুবিধাজনক স্থানে পদায়ন করা যাবে।
প্রেষণে পাবেন উচ্চতর পদ: নীতিমালা অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, দপ্তর, পরিদপ্তর, অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সংস্থায় নিজস্ব পদের বাইরে ভিন্ন পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া যাবে এবং পদায়নের ক্ষেত্রে পদটি উচ্চতর পদ হবে। কোনোভাবেই সমপদের নিচের পদে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তবে কোনো কর্মকর্তা একই স্থানে বা একই পদে তিন বছরের বেশি থাকতে পারবেন না। বিশেষ ক্ষেত্রে সময়সীমা শিথিল করা হলেও তা কোনোভাবেই একটানা পাঁচ বছরের বেশি হবে না। এজন্য কাজের প্রকৃতি ও কর্মচারীর অভিজ্ঞতা গুরুত্ব পাবে।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা পদোন্নতি পাবেন তাদের বর্তমান কর্মস্থল থেকে বদলি করে অন্য মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হবে। মাঠ প্রশাসনে কমপক্ষে পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তাকেই মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করবে না সরকার। মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কোনো কর্মচারীকে পদায়ন করা হলে ওই পদে তার চাকরির সময়সীমা হবে দুই বছর। দুই বছরের আগে তাকে বদলি করা যাবে না। আবার তিন বছরের অধিককাল থাকতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে আর্থিক বছর ও বর্ষপঞ্জির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে। কোনো সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপসচিব সচিবালয়ে পদায়িত থাকলে তাকে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মাঠ প্রশাসনের পদে পদায়ন করতে হবে।
পাবেন প্রশিক্ষণ ভাতা: প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রেষণে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ভাতা দেওয়া হবে। দক্ষ, সৎ, মেধাবী ও উচ্চতর বিদেশি ডিগ্রিধারী এবং শিক্ষাজীবনে সব পরীক্ষায় ভালো ফলপ্রাপ্তদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে পদায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। প্রেষণে নিযুক্ত এসব কর্মকর্তার জন্য সরকারি বৃত্তি ও উচ্চতর বিদেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। তবে চাকরিকাল স্থায়ী হওয়াসহ পাঁচ বছর না হলে কোনো কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করা যাবে না। কোনো কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করা হলে তিনি কমপক্ষে দুই বছর সেই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকবেন।
প্রকল্পে পদায়ন: একজন প্রকল্প পরিচালককে (পিডি) একটি প্রকল্প শেষ হওয়ার পরপরই আরেকটি প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা যাবে না। কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ওপর মৌলিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা ওই বিষয়ে পড়াশোনা থাকতে হবে। প্রয়োজনে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে একটি দক্ষ পিডি পুল গঠন করতে হবে। পিডি পুল থেকে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে পদায়ন করা যাবে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি হলেই পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ করতে হবে। তিন বছরের আগে বদলি করা যাবে না।সৌজন্যে-সমকাল
Discussion about this post