আবদুল আজিজ
পরিচ্ছন্ন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। যেখানে-সেখানে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। কেয়াবন ও প্রবাল দ্বীপ থেকে শুরু করে সাগরে যত্রতত্র বর্জ্য ফেলার কারণে দূষিত হচ্ছে দ্বীপের নীল জলরাশি। বর্জ্যের চাপে মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে সেখানকার জীববৈচিত্র্য।
স্বচ্ছ নীল জলরাশি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দ্বীপটিতে প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে আসেন হাজারো পর্যটক। এসব পর্যটকের কারণে দ্বীপ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সৌন্দর্য রক্ষার্থে বিধিনিষেধ আরোপ করে নানামুখী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। কাজ করছে পরিবেশ অধিদফতরসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু, আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিক, চিপসের প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, পানির বোতল, স্ট্র, প্যাকেট, মাছ ধরার জালের টুকরো, নাইলনের দড়িসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য। এ ছাড়া ছোটবড় শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁর পাশাপাশি যোগ হয় গৃহস্থালীর বর্জ্য। এ কারণে পরিবেশ অধিদফতরসহ দ্বীপ নিয়ে কাজ করা সংস্থার কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশকর্মীরা।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রশীদ আহমদ বলেন, ‘দ্বীপকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কথা শুনি। কিন্তু, বাস্তবে কিছুই দেখতে পাই না। সেন্টমার্টিনজুড়ে ময়লা-আবর্জনা। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলোর বর্জ্য যাচ্ছে সরাসরি সাগরে। এগুলো দেখার জন্য সেন্টমার্টিনে কেউ নেই।’
একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন আসেন। তারা অন্তত কয়েক হাজার কেজি বর্জ্য সৃষ্টি করেন। এসব ধারণের মতো ডাস্টবিনও দ্বীপে নেই। মাঝেমধ্যে কিছু প্লাস্টিকের বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হলেও বেশিরভাগ বর্জ্য যত্রতত্র পড়ে থাকে, সাগরে ভেসে যায়।’
ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহাম্মদ বলেন, ‘দ্বীপের শতাধিক হোটেল-মোটেলকে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয় যেন তাদের ময়লা-আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলে। কিন্তু, কেউ কথা শোনে না। আগে দ্বীপের সব বর্জ্য সংগ্রহ করে বড় ডাস্টবিনে রেখে সপ্তাহ দুয়েক পরপর পুড়িয়ে ফেলা হতো। আমি দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার পর এটা আর হয় না।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে কিছু সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। তারা পর্যটক এবং স্থানীয়দের স্বার্থে কিছুই করেন না। দ্বীপ এবং সৈকত পাড়ে রয়েছে অনেক দোকান। এসব দোকানি ডাব, পানীয় এবং খাদ্য বিক্রি করে পর্যটন মৌসুমে ভালো ব্যবসা করেন। কিন্তু, সৈকত পাড়ের দোকানিরা বিচের আশপাশে ময়লা রেখে দেন।’
সেন্টমার্টিনে দায়িত্বরত পরিবেশ অধিদফতরের কর্মী আব্দুল হামিদ বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলতে প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু পর্যটকরাই তো পাত্তা দেন না। পরিবেশ অধিদফতর একা তো দ্বীপ রক্ষা করতে পারবে না। দ্বীপের প্রশাসনও এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে না।’
ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা প্রকৌশলী পারভীন আক্তার বলেন, ‘দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তা না হলে দিন দিন এ দ্বীপ নষ্ট হয়ে যাবে। হুমকিতে পড়বে এখানকার বাস্তুসংস্থান।’
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘দ্বীপ রক্ষায় একের পর এক প্রকল্প নিচ্ছে সরকার। কিন্তু কাজে আসছে না। চারদিকে এখনও ময়লার স্তূপ।’
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘অতিরিক্ত পর্যটক আসায় প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে দ্বীপ। এজন্য অন্তত পর্যটন এলাকাগুলোতে পলিথিন ও চিপস নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।’
এই সমুদ্র বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘পরিবেশবিরোধী এসব আবর্জনায় হারিয়ে যেতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল ও জলজ বাস্তুসংস্থান।’
১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও টেকনাফ সৈকতসহ দেশের ছয়টি এলাকাকে সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। তা সত্ত্বেও পর্যটকের অবাধ যাতায়াত, দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রেখে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ, কেয়াবন উজাড়, পাথর উত্তোলন করে নির্মাণকাজে ব্যবহারসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কাজ চলছেই। এতে গত দেড় যুগে দ্বীপের ভাঙনও প্রকট হয়েছে। এ ছাড়া শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবাল, পাথর আহরণ ও সরবরাহও চলছে।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম বলেছেন, ‘সেন্টমার্টিনে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়ে বৃহস্পতিবার চার রিসোর্টকে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ সময় অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণের দায়ে আটলান্টিক রিসোর্ট ও ড্রিমস প্যারাডাইস রিসোর্টকে এক লাখ টাকা করে, ফ্রেন্ডস রিসোর্টকে ৫০ হাজার ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়ে প্রিন্স হ্যাভেন রিসোর্টকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।’
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতর ও মৎস্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, সেন্টমার্টিন দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭-১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও ১২০ প্রজাতির পাখি।
এ ছাড়া সামুদ্রিক কাছিম, সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি প্রসিদ্ধ।সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post