গোলাম মওলা
করোনা মহামারির প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে লেবানন। দ্রব্যমূল্য সামাল দিতে না পেরে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে শ্রীলঙ্কাতেও। এমনকি উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে পাকিস্তানের ‘রাজনৈতিক সংকট’ এখন মোড় নিচ্ছে ‘অর্থনৈতিক সংকটের’ দিকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে বিপর্যস্ত এই দেশগুলো, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করছেন কেউ কেউ। তবে বিপর্যস্ত এই তিনটি দেশের তুলনায় ভালো আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
টানা ২ বছরেরও বেশি সময় করোনার ভয়াবহ বিস্তারের কারণে বিশ্বের অপরাপর দেশের সঙ্গে আমদানি-রফতানির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হওয়া, বেশ কিছু আমদানি নির্ভর দ্রব্যের উৎপাদন কম হওয়া, করোনার অভিঘাত কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানা টানাপড়েন এবং নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক বছরে যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছে, গত এক দশকেও এতটা বাড়েনি। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও। সেই সঙ্গে রয়েছে অসাধু মুনাফালোভী মজুতদারদের অপতৎপরতাও।
তবে সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগ বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ওপেন মার্কেট সেলসের (ওএমএস) আওতা বাড়িয়েছে। এ খাতে ভর্তুকিও বাড়ানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার তার ওএমএস ভর্তুকি ৮০০ কোটি টাকা বা ১৯ শতাংশ বাড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের কিছু করার থাকে না। তবুও নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য যতটুকু করার আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করছি। রমজানকে সামনে রেখে আমরা টিসিবির মাধ্যমে কম মূল্যে মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো দেওয়ার চেষ্টা করছি।
মূল্য নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখছে টিসিবি
করোনা মহামারির মধ্যে সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করেছে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। এসময় তাদের ভরসা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য। রোজার মাসেও নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে টিসিবি। টিসিবির কারণে আন্তর্জাতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও সমাধান পেয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চলতি বছর টিসিবির পণ্যের বিক্রি বাড়ানো ও মনিটরিং জোরদার করায় দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ায় দেশের দুর্যোগের এসময়ে নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের জন্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফুল হাসান বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিসিবি একটি বড় ভূমিকা রাখে। বাজার মনিটরিং, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ডিমান্ড মেনটেইন করার ক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইনে টিসিবি ভূমিকা রাখে।
পণ্য সরবরাহে ঘাটতি নেই
পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখার অংশ হিসেবে সরকার বিধিনিষেধ তুলে দেয়। এ কারণে পণ্য আনা-নেওয়ার কোনও সমস্যা হয়নি। দাম কিছুটা বাড়লেও বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক আছে।
এছাড়া সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (টিসিবি) এবারও দ্বিগুণের বেশি নিত্যপণ্য বিক্রি করছে। রোজায় স্বল্পআয়ের মানুষের কাছে সস্তায় সংস্থাটি ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ এবং খেজুরের মতো ভোগ্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছে।
রমজানে আগে নেওয়া আরও কিছু পদক্ষেপ
রমজান মাস শুরুর কয়েক মাস আগে ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডালের মতো ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দ্রুত এলসি খোলার তাগিদ দেওয়া হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, আমদানি বাড়িয়ে পেঁয়াজ, ছোলা এবং খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে।
বাজার তদারকিতে জোরদার
নিত্যপণ্য নিয়ে কারসাজি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে রমজানে মাসব্যাপী বাজার তদারকি করা হচ্ছে। এ ছাড়া খাদ্যে ভেজালরোধে নিরাপদ খাদ্য অধিদফতরের বিশেষ টিম বাজার তদারকি করছে। ন্যায্যমূল্য ও সঠিক পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা, তা দেখভালে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর বাজারে রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাজার তদারকি করছে র্যাব ও পুলিশের বিশেষ টিম। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘বাজার মূল্য পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ’বিষয়ক স্থায়ী কমিটি কাজ করছে। পাশাপাশি অসাধু মুনাফাখোর মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, হাজার হাজার টন ভোজ্যতেল উদ্ধার হচ্ছে।
মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সারাদেশে বাজার পর্যবেক্ষণ করছে, আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকা মহানগরীতে যৌথ টিম প্রতিদিন কাজ করছে। মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এসব টিম কাজ করছে।
এনবিআরের উদ্যোগ
সয়াবিন তেলের উৎপাদন, খুচরা ও এমনকি আমদানি পর্যায়ে সরকার মোট ৩০ শতাংশ কর ছাড় দিয়েছে ব্যবসায়ীদের। ইতিমধ্যে এর ফলও পেতে শুরু করেছে। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে গড়ে দশ টাকার মতো কমেছে। এছাড়া চিনি আমদানিতেও শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার।
পেঁয়াজের শুল্ক মওকুফের সুফল
দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রাখতে পেঁয়াজের শুল্ক গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ করা হয়। তবে দাম কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরায় জানুয়ারি থেকে পুনরায় ৫ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হয়েছে। শুল্কমুক্ত করায় পেঁয়াজের স্বল্পতা মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে নতুন পেঁয়াজ উঠেছে। বিগত সময়ে ভারতে পেঁয়াজের দাম বৃষ্টির কারণে বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের কেজি ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে এখন সেটি সহনশীল অবস্থায় ফিরেছে।
আমদানি বিকল্প কৃষিপণ্যর উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষি খাতে উদার ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশের গরিব কৃষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ভর্তুকির টাকা পুরোপুরি খরচ করা হয় না।
সরাসরি শাস্তির ব্যবস্থা
কেউ পণ্যের অতিরিক্ত দাম রাখলে ১৬১২১ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে টিসিবির বিক্রয় কার্যক্রম চলমান থাকায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারমূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, করোনা মহামারিতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব দেশেই দ্রব্যমূল্য ভীষণভাবে বেড়েছে। এর মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর কুফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। তবে জনবান্ধব বর্তমান সরকার দেশের নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সম্ভাব্য সব রকম পদক্ষেপ নিয়েছে।
বুধবার (৬ এপ্রিল) জাতীয় সংসদে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে তার সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের নানামুখী কার্যক্রমের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি নিত্যপণ্যে টিসিবির বর্তমান ও আগের বাজারমূল্যের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা জানান, গত ১ মার্চ সয়াবিন তেলের এক লিটার বোতলের বাজারমূল্য ছিল ১৭০ টাকা, ৫ এপ্রিল এ মূল্য কমে হয়েছে ১৬১ টাকা ৫০ পয়সা। এ সময় সয়াবিন খোলা প্রতি লিটার ১৭৫ থেকে কমে ১৫৫ টাকা এবং পাম ওয়েল প্রতি লিটার ১৫৮ থেকে কমে ১৪২ টাকা হয়েছে। এছাড়া টিসিবি সয়াবিন তেলের প্রতি লিটার ক্যান বিক্রি করেছে ১১০ টাকায়। তিনি আরও জানান, মসুর ডালের কেজি গত ১ মার্চ ছিল ১২০ টাকা। তা কমে ৫ এপ্রিল হয়েছে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। এসময় টিসিবি বিক্রি করেছে ৬৫ টাকা কেজিতে। খোলা চিনি প্রতি কেজি ১ মার্চের ৮৫ টাকা থেকে কমে ৫ এপ্রিল হয়েছে ৭৮ টাকা। এ সময়ে টিসিবি বিক্রি করছে ৫৫ টাকা কেজি দরে। ছোলার কেজি ১ মার্চের ৭৭ থেকে কমে ৫ এপ্রিল ৭২ টাকা ৫০ পয়সায় নেমেছে। এ সময় টিসিবি বিক্রি করেছে ৫০ টাকা কেজি। পেঁয়াজ ১ মার্চের ৬০ টাকা কেজি থেকে কমে ৫ এপ্রিল হয়েছে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা। টিসিবি বিক্রি করছে ২০ টাকা কেজি দরে।
যেখানে শ্রীলঙ্কা ফেল সেখানে বাংলাদেশ পাস
একসময় সামাজিক সূচকে শ্রীলঙ্কা ছিল এ অঞ্চলের সেরা। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশের বেশ কিছু যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যে বড় পার্থক্য তৈরি করে দেয়।
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাস্তবায়ন
শ্রীলঙ্কা যখন তার দেশে ভ্যাট কমায় তখন বাংলাদেশ ভ্যাট আইন কার্যকর করে। দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে জনপ্রিয় পদক্ষেপ হিসেবে এক ধাক্কায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ ধার্য করেন। একইসঙ্গে ২ শতাংশ হারের নেশন উন্নয়ন কর (নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স), যত আয় তত কর (পে অ্যাজ ইউ আর্ন—পিএইউই) ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রাজস্ব আয়ে। এক বছরেই দেশটির ভ্যাট আদায় কমে যায় ৫০ শতাংশ।
এদিকে একই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশে ভ্যাট আইন কার্যকর হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে একক হারের পরিবর্তে ভ্যাটের ৪ স্তর করা হয়। বাংলাদেশে নতুন আইনে ভ্যাটের আওতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়। পুরনো ১৯৯১ সালের আইনে শুধু আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী স্তর এবং সেবার ওপর ভ্যাট ছিল। সেখানে নতুন আইনে আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী স্তর এবং সেবার সরবরাহ ও আমদানির ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়।
করোনা মহামারি চলাকালে বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ের রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। করোনার মধ্যেই তৈরি পোশাক কারখানা খোলা থাকায় রফতানি আয়ের বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, এই সময়ে আমদানি ব্যয় কমে যায়। এর ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় পাওয়ায় সংকটে পড়ে শ্রীলঙ্কা। দেশটির বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে না পণ্য। কিন্তু বাংলাদেশে পণ্যের কোনও ঘাটতি নেই।সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post