গোলাম মওলা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে খানিকটা ধীরগতি দেখা গেলেও বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিকই আছে। আগের চেয়ে গতিও সঞ্চার হয়েছে। অর্থনীতির বেশ কয়েকটি সূচক এখন ইতিবাচক ধারায়।
রফতানি আয়ে স্বস্তির সুবাতাস পাওয়া যাচ্ছে বেশ কয়েকমাস ধরে। গত মাসের তুলনায় প্রবাসী-আয়ও বেড়েছে। বাড়তে শুরু করেছে বিনিয়োগ।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে আশাবাদী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-এর পূর্বাভাসেও উঠে এসেছে এমন চিত্র। সংস্থাটি চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আমদানি ব্যয় খানিকটা বেড়েছে। তবে করোনা চলে যাওয়ার পর অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হয়েছে।
রফতানি আয়
দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। এর ওপর ভর করে লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে রফতানি আয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৩ হাজার ৮৬১ কোটি মার্কিন ডলার রফতানি আয় করেছে বাংলাদেশ। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৬৭ কোটি ডলার বেশি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬০১ কোটি ডলার বেশি আয় হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে পোশাক রফতানি থেকেই আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৪২ কোটি ডলার। যা মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮১ শতাংশ।
এ সময়ের মধ্যে পোশাক রফতানিতে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৯৪ কোটি ডলার বেশি আয় হয়েছে।
পোশাকের এ প্রবৃদ্ধির কারণে গত ৯ মাসে এ খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০৯ কোটি ডলার বেশি রফতানি আয় হয়েছে দেশের।
গত জুলাই থেকে মার্চ, এই সময়ে তৈরি পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৩৩ কোটি মার্কিন ডলারের।
প্রবাসী আয়ে চাঙা ভাব
গত মার্চে প্রবাসীরা দেশে প্রায় ১৮৬ কোটি মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন (১৬ হাজার ৩৩ কোটি টাকা)। এই আয় গত আট মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি এপ্রিলে প্রবাসী আয় মার্চের তুলনায় বাড়বে বলে আশা করছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রবাসীরা দেশে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ ডলার পাঠান। ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তবে মার্চে বেড়ে ১৮৫ কোটি ৯৯ লাখ ডলারে ওঠে।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে
করোনার প্রভাব কমে আসার পর থেকেই বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকটি টানা আট মাস ধরে বাড়তে বাড়তে এ বছরের জানুয়ারিতে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১২ লাখ ৬৬ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
সাধারণত দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে মনে করা হয় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহকে।
ঋণের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, ‘টানা সাত-আট মাস বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো খবর।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।
রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা
প্রতি বছর বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে কর সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, সাধারণত অর্থবছরের শেষে সংশোধিত বাজেটে তা কিছুটা কমানো হয়।
কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কর রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কমছে না, অপরিবর্তিত থাকছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে কর রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটেও একই লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে বলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৩ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ে গতি বেড়েছে
এনবিআরের তথ্য বলছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা এবং আমদানি বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব সংগ্রহ বেড়েছে। আমদানি পর্যায়েও রাজস্ব সংগ্রহ বেড়েছে। বেড়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) থেকে আদায়। এমনকি করোনার মধ্যেও আয়কর সংগ্রহ বেড়েছে।
এ বছর রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে আশা করছে এনবিআর।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও রফতানির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়বে।
পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হওয়ায় গুগল, অ্যামাজন, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান থেকেও রাজস্ব পাওয়া যাচ্ছে।
এ ছাড়া এ বছর কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে। এতে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি দুটিই বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে এনবিআর। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।
তথ্য বলছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৬ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব সংগ্রহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এ খাতে আদায় হয়েছে ৫৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।
এছাড়া ৫২ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকার রাজস্ব এসেছে আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর থেকে। প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।
ভ্রমণ কর হিসাবে এনবিআর পেয়েছে ৪৫৪ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় ১৪১ শতাংশ বেশি।সৌজন্যে-বাংলাট্রিবিউন
Discussion about this post