বিশেষ প্রতিবেদক
বর্ষীয়ান লেখক, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও জনপ্রিয় কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর নেই। আজ বৃহস্পতিবার লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে স্থানীয় সময় সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য কিডনি জনিত রোগে ভুগছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই প্রখ্যাত সাংবাদিক।যুক্তরাজ্যের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও গাফ্ফার চৌধুরীর পারিবারিক ঘনিষ্ঠজন ইয়াসমিন মাহমুদ পলিন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
৮৭ বছর বয়সী গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৭৪ সালের অক্টোবর থেকে ব্রিটেনে বসবাস করছিলেন। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু দিন ধরে হাসপাতালে ছিলেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’র প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ সালে বরিশালের উলানিয়ার চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডনের মিডলসেক্সে এজোয়ার এলাবার মেথুইন রোডের ৫৬ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন।
ছাত্রজীবনে লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। ১৯৪৯ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত মাসিক সওগাত পত্রিকায় তার গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাংবাদিকতায় হাতেখড়িও ছাত্রজীবনে। ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালে যোগ দেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। ১৯৫১ সালে যোগ দেন খায়রুল কবীর সম্পাদিত দৈনিক সংবাদের বার্তা বিভাগে। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কলমযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জয় বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মডারেটরের ভূমিকাও পালন করেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে লন্ডনে যান।এরপর তার প্রবাসজীবনের ইতিহাস শুরু হয়।
তিনি ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে পাড়ি জমান। ১৯৭৬ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সেখানে ‘বাংলার ডাক’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও কিছুদিন কাজ করেন। পরে তিনি ‘নতুন দিন’ ও ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকা বের করেন। প্রবাসে থাকলেও গাফ্ফার চৌধুরী আমৃত্যু বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত লিখে গেছেন। এছাড়া ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন নানা সভা-সেমিনারে।
তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পদক, ইউনেস্কো পদক, বঙ্গবন্ধু পুরস্কারসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার লাভ করেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ৩০। এছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে আছে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’।
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত আবদুল গাফফার চৌধুরীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
Discussion about this post