অনলাইন ডেস্ক
ফেরি-সংকট, আবহাওয়া, যানজট—এই তিন কারণে পদ্মা পার হতে না পেরে তরমুজ বোঝাই শতাধিক গাড়ি আটকে পড়ার খবর কারও অজানা নয়। মাদারীপুরের কলাই শাক, শরীয়তপুরের সবজি, ফরিদপুরের খেজুরের রস, বরিশাল, পটুয়াখালীর তরমুজ, বাঙ্গি, আমড়া ও ডিমবাহী ট্রাকও পদ্মার পাড়ে আটকে থাকতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক সময় পচেই যেতো এসব। পচে যাওয়ার ভয়ে কৃষকরাও অনেক সময় জলের দরে বিক্রি করে দিতো এসব পণ্য। এমন অসহায়ত্বের অবসান ঘটতে যাচ্ছে এবার। চালু হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
পদ্মাপারের জেলা মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জের ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানিয়েছেন, ফেরি পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ট্রাকের দুরবস্থার কথা মনে হলে তারা আঁতকে ওঠেন। একদিকে কষ্ট, আরেকদিকে থাকতো পুঁজি হারানোর ভয়।
‘পরিবারকে বলে আসতাম তিন দিন পরে আসবো, কিন্তু সাত দিনেও ফিরতে পারিনি। পদ্মার পাড়ে না খেয়ে থেকেছি, বাড়ির লোকও না খেয়ে দিন কাটিয়েছে।’
সেই দিনগুলোর কথা এখন আর মনে করতে চান না মাদারীপুরের ব্যবসায়ী আকবর হোসেন। কারণ, ২৬ তারিখ সকাল থেকে আর করতে হবে না সেই দুঃসহ অপেক্ষা।
রাজধানীর শ্যামবাজারের সবজি ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন জানিয়েছেন, ‘পদ্মার ওপারের জেলাগুলো থেকে বেশ কিছু সবজি ও ফল ঢাকায় আসে। তবে পদ্মা পার হওয়ার ওপর নির্ভর করে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল বা পটুয়াখালী থেকে সবজি ও ফল ঠিক সময়ে রাজধানীতে পৌঁছাবে কিনা। অনেক সময় আমরা সেসব জেলার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সবজি ও ফল আনার জন্য চুক্তি করি। সেই অনুযায়ী বায়নাও করি। কিন্তু দেখা যায়, ফেরি-সংকট বা আবহাওয়ার কারণে নদী পার হতে না পেরে পণ্যের সরবরাহ ঠিক সময়ে পাই না। এতে ক্ষতি হয় অনেক। এটা এতদিন ছিল নিয়মিত ঘটনা।’
ওপারের মানুষরাও জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অবস্থা এমন থাকবে না। ২১ জেলার কৃষিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাড়বে চাষাবাদও। উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত নিয়ে আর দুশ্চিন্তা থাকবে না। ক্রেতারাও সব তাজা পাবেন। আড়তদারদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ হওয়ার সুযোগও তৈরি হবে না। ফলে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে।
সেতু উদ্বোধনের সংবাদে খুশির বন্যা বইছে পদ্মার ওপারের আরেক জেলা ঝালকাঠিতে। বিশেষ করে এই জেলায় উৎপাদিত পেয়ারা, আমড়া ও শীতলপাটি সহজেই এখন চলে আসবে রাজধানীসহ আরও অনেক জেলায়। ঝালকাঠি থেকে ঢাকা যেতে আগে সময় লাগতো ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু চালু হলে লাগবে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য আর কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জেলা ঝালকাঠির পেয়ারা, আমড়া ও শীতলপাটি দেশ-বিদেশে সুপরিচিত। ফেরিজটে পড়ে এসব পণ্য নষ্ট হওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল এতদিন। পদ্মা সেতু চালুর পর এসব বাধা আর থাকবে না।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর কোলঘেঁষে থাকা ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার কৃষিজমি মসলা জাতীয় পণ্য উৎপাদনের উপযোগী। এতে এসব এলাকায় মসলা জাতীয় পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতও বাড়বে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, শরীয়তপুরের জাজিরাসহ আশপাশের এলাকায় বিস্তীর্ণ কৃষিজমি রয়েছে। এখানেই মূলত মসলা জাতীয় পণ্য ও শাকসবজির চাষ হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যায় এতদিন কৃষকরা ন্যায্য দাম পেতেন না। তাই উৎসাহ নিয়ে কৃষকরা এসব চাষও করতেন না। সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্যের চাকাও ঘুরবে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ঝালকাঠির ৬৫০ হেক্টর জমিতে ১৫ হাজার ৪৭০ জন কৃষক আমড়ার চাষ করেন। এখান থেকে বছরে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন আমড়া সারা দেশে যায়। এই একটি ফল থেকেই এখানকার কৃষকরা আয় করছেন ২৫ কোটি টাকা।
আবার এখানকার শত শত হেক্টর জমিতে আছে পাইত্রা গাছের বাগান। যা দিয়ে বছরজুড়ে এই গ্রামগুলোতে শীতল পাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি তৈরি হয়। সেতু চালুর ফলে এসব পণ্যের বাজারও বেড়ে যাবে হু হু করে।
জানা গেছে, এসব জেলার শীতল পাটি থেকেই বছরে আয় হয় ১০ লাখ টাকা। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই শীতল পাটির ব্যাপক চাহিদা আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এতদিন কারিগররা পণ্যটি কম দামে বিক্রি করে দিতেন। পদ্মা সেতু চালুর পর কারিগররাই সরাসরি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যটি পৌঁছে দিতে পারবেন।
এ বিষয়ে বরিশালের কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল আলম জানান, বরিশালের ধান, নারিকেল, সুপারির পাশাপাশি নতুন করে ব্যাপক জমিতে তরমুজের চাষ হচ্ছে। চাষ হচ্ছে আমড়া ও পেয়ারা। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানকার ফলগুলো পদ্মার ওপারে বিশেষ করে রাজধানীতে পাঠানো ছিল কঠিন কাজ। সেতু চালু হলে এখানকার পেয়ারা, আমড়া ও তরমুজের বাজার হবে রমরমা।’ সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post