হজরত ইব্রাহিম (আ.) মহান আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ আত্মসমর্পণকারীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং তাঁর পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই নিজের সর্বোত্তম প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। সেই থেকে মানুষের জীবনের পরিবর্তে পশুর প্রাণ নিবেদনের মাধ্যমেই পবিত্র কোরবানির প্রচলন শুরু হয়।
পবিত্র ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি মানুষের মধ্যে ত্যাগের আবহ নিয়ে আসে। কোরবানির মাংস গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়েও অপার আনন্দ ও সওয়াব পাওয়া যায়। ধর্মীয় বিধানও এমনই। ঈদুল আজহাকে কেবল পশু জবাই আর মাংস খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না।
ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করা হয় রূপক অর্থে। কোরবানি তথা উৎসর্গ যেমন পশুকে করা হয়, তেমনি আমাদের মনে সকল পাপ-পঙ্কিলতা ধুয়েমুছে সাফ করাও এর বাইরে নয়। সৎ পথে উপার্জিত অর্থে কেনা পশুর মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে।কুরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া তথা অন্তরের সুপ্ত বাসনাই হচ্ছে আসল। আল্লাহ বলেছেন, তাঁর কাছে রক্ত-মাংস পৌঁছায় না। কিন্তু তাঁর কাছে যায় মনের তাকওয়া।
ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশি একথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি কজনই বা গুরুত্ব দিচ্ছি ! ঈদ যেমনি আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন মানসিকতা বিসর্জন দেওয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায় নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার।
কোরবানির ত্যাগের যে মহান আদর্শ সেটি ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। মনের পশুকে পরাস্ত করে মানবিকতার উন্মেষ ঘটানোই হচ্ছে মূলকথা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্য এবং সংহতির পরিবেশ গড়ে তোলাটা জরুরি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘কোরবানী’ কবিতায় যেমনটি বলেছেন- ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন !/ দুর্বল! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন !/ ধ্বনি উঠে রণি’ দূর বাণীর, -/ আজিকার এ খুন কোরবানীর !’
এবার এমন এক সময়ে ঈদুল আজহা এসেছে যখন সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের অন্তত ১৬টি জেলার মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ি-বাসস্থান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে অনেকের। বন্যার্তদের অনেকেরই এবার কোরবানি দেওয়া তো দূরের কথা, উৎসবের সাধারণ আয়োজন করার সামর্থ্য নেই। কোরবানির ত্যাগ ও সহমর্মিতার শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা মনে করি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। তা ছাড়া কোরবানির মাংস ও পশুর চামড়ার অর্থও ওই অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করা যায়।
আশঙ্কিত করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের এই দুঃসময়ে ঈদুল আজহা উদযাপনে সংশ্নিষ্ট ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতিপালন, নগর-গ্রাম স্থানান্তর-জনাসমাগম-লোক দেখানো মাংস বিতরণে যাতে সংক্রমণ বিস্তার ও প্রাণ নিধনের পরিসংখ্যান ঊর্ধ্বমুখী করে বাংলাদেশকে পর্যুদস্ত না করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকার কর্তৃক নির্দেশিত স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন বিধিনিষেধ উপেক্ষিত হওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।
তাই আসুন ঈদুল আযহার প্রকৃত মহত্ত্ব ও তাৎপর্য নিজে লালন করতে শিখি। অসুন্দর ও কলুষিত হৃদয় পবিত্র করার লক্ষ্যে ঈদুল আজহায় শিক্ষা গ্রহণ করি। করোনার এই দুর্যোগ ও মহামারীতে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। অন্য সময় দান সদাকাহ এবং সহযোগিতার পরিমাণ যেটুকু ছিল এখন সেটা আরো বাড়াতে চেষ্টা করি। সবিশেষ সকলের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই।ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক- এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা।
Discussion about this post