শিক্ষার আলো ডেস্ক
দেশের কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান। স্থলজ ও জলজ উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত কৃষিবিজ্ঞানের সকল শাখাই এর কার্যক্রমভুক্ত। ‘পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৬১’-এর প্রেক্ষিতে ১৯৫৯ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৬১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং উপাচার্য নির্বাহী প্রধান।মানসম্পন্ন উচ্চতর কৃষিশিক্ষা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশে কৃষি উন্নয়নের গুরুদায়িত্ব বহনে সক্ষম তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কৃষিবিদ, প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও কৃষি প্রকৌশলী তৈরির লক্ষ্যেই ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়।
ময়মনসিংহ শহর থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে এক হাজার ২০০ একর জায়গায় অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এটি প্রকৃতকন্যা নামে পরিচিত। সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা ১২০০ একরের এই ক্যাম্পাস সবাইকে আকৃষ্ট করে। তাই বার বার দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন এই সবুজ চত্বরে।
কৃষিবিজ্ঞানের সকল শাখা এর আওতাভুক্ত। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের কৃষির উন্নয়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কাজ করে চলেছে এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা।
আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি খাদ্য শস্য উৎপাদন। যেটি সম্ভব হয়েছে কৃষিবিদদের অবদানে। বাকৃবির হাজার হাজার কৃষি গ্র্যাজুয়েট দেশের বিভিন্ন কৃষি সেক্টরে নিজেদের সম্পৃক্ত করে দেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শস্যের জাত, চাষাবাদ কৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রসারে সাফল্য অর্জন করেছে। এসব প্রযুক্তি দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখছে। উদ্ভাবিত ফসলের জাতের মধ্যে রয়েছে BAU-63 এবং BAU-16 নামে দুটি আধুনিক ধানের জাত; সম্পদ ও সম্বল নামে দুটি উচ্চ ফলনশীল সরিষা; সয়াবিনের চারটি কালটিভার ডেভিস, ব্রাগ, সোহাগ ও জি-২; মিষ্টি আলুর দুটি কালটিভার- কমলাসুন্দরী ও তৃপ্তি এবং মুখি কচুর (Colocasia esculenta) তিনটি কালটিভার- লতিরাজ, বিলাসী ও দৌলতপুরী (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যৌথভাবে)। চাষাবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলির মধ্যে আরও রয়েছে বীজবপন যন্ত্র, সার ছিটানো যন্ত্র, মাটি পরীক্ষার কিট, জীবজসার (biofertilizer), বহুবর্ষজীবী পাতাজাতীয় সবজির চাষ, ধইঞ্চার জোড়কলম প্রভৃতি। বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি, পেয়ারা গাছের নেতিয়ে পড়া (wilt) রোগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল, ফলের রস সংরক্ষণের আধুনিক প্রযুক্তি প্রভৃতি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণালব্ধ বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি মৎস্য ও পশুসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, যেমন পোল্ট্রি ভেকসিন উৎপাদন, মুরগির বসন্ত ও রানিক্ষেত টিকা উদ্ভাবন, গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন, সুষম ‘পোল্ট্রি ফিড’, গরুর খাবার হিসেবে ‘ইউরিয়া মোলাসেস’-যুক্ত খড়ের ব্লক, স্কেভেনজিং পোল্ট্রির উন্নত জাত, ধানক্ষেতে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের চাষ, মাগুর ও শিং (Heteropneustes fossilis) মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল, মাগুর (Clarias batrachus) চাষে কৃত্রিম খাবার প্রভৃতি। উন্নত লাঙল, সোলার ড্রায়ার, কম খরচে সেচনালা প্রস্ত্তত, মাটি-সিমেন্ট ও ফেরো-সিমেন্টে তৈরি শস্যগুদাম, বায়োগ্যাস প্লান্ট প্রভৃতি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কার্যক্রম, বিশেষভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও জীবপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।
ধান, সরিষা, কুল, সয়াবিন, আলু, আম, লিচু, মুখিকচুসহ বেশ কিছু ফসলের কয়েকটি করে উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার ফলদ, ভেষজ প্রজাতির বৃক্ষসমৃদ্ধ এখানকার জার্মপ্লাজম সেন্টারটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং দেশে প্রথম। গাঙ মাগুর, কই, বাটা মাছ, তারাবাইন, গুচিবাইন, বড় বাইন, কুঁচিয়াসহ বিভিন্ন মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণাকে বেগবান করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশকিছু বিশেষায়িত গবেষণাগার।
বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১৯৮৪ সালের ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাউরেস উদ্ভাবিত উন্নত কৃষি প্রযুক্তিগুলো সম্প্রসারণের জন্য ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ কেন্দ্র। এ সম্প্রসারণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। গত বছর বাউরেসের অধীনে ৩৪৭৬টি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট ছয়টি অনুষদে ৪৬টি বিভাগ রয়েছে। এখান থেকে বর্তমানে ৮টি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়। বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সাত হাজার ৯২৩ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ৫৬৩ জন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৬টি অনুষদ ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ছেলেদের জন্য ৯টি ও মেয়েদের জন্য ৫টি আবাসিক হল (সর্বশেষ শেখ হাসিনা হল) রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ২৬৮ জন স্নাতক, ২০ হাজার ১৪১ জন স্নাতকোত্তর এবং ৮৩৫ জন পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।
এছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি, ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, উপমহাদেশের প্রথম মৎস্য জাদুঘর এবং প্রায় সাড়ে চার হাজার বৃক্ষসমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফলের জাত উন্নয়নের জন্য জার্মপ্লাজম সেন্টার, উদ্ভিদের রোগ নির্ণয়ের ক্লিনিক, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ কেন্দ্র (বাউএক), সিড প্যাথলজি সেন্টার, কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, বায়োটেকনোলজি ল্যাব, ভেটেরিনারি ক্লিনিকসহ কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন সুবিধা সংবলিত স্থাপনা।
বর্তমানে বাকৃবির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। তিনি লবণাক্ততা সহিষ্ণু তিনটি সরিষার জাত এবং বাউধান-৩ উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সিআইপি মর্যাদায় এআইপি (এগ্রিকালচারলি ইম্পরট্যান্ট পারসন) হিসেবে ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সম্মাননা-২০২০’ পদকপ্রাপ্ত হন।
Discussion about this post