এমরান হোসাইন শেখ
গত ১৮ বছর ধরেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের পাশে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারকীয় সেই হামলার পর শেখ হাসিনা নিজেও ট্রমার মধ্যে ছিলেন। তারপরও ঘটনায় নিহতদের দাফন থেকে শুরু করে আহতদের চিকিৎসা; পরিবারের দেখভাল, কর্মসংস্থান, অনুদান—বাদ রাখেননি কিছুই।
মারাত্মক আহতদের তাৎক্ষণিক পাসপোর্ট-ভিসা করিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। স্থায়ী পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা করেছেন অনেককে।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ২১ আগস্টের ভিকটিমদের জীবনধারণের জন্য যা করার সবই করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থান, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, চিকিৎসা ও ওষুধ জোগাড়, স্থায়ী আয়ের জন্য সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়া; এমনকি এফডিআরের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি।
কাউকে গ্রামে করে দিয়েছেন বাড়ি, ঢাকায় কিনে দিয়েছেন ফ্ল্যাট। দল ও সহযোগী সংগঠনে দিয়েছেন পদ-পদবি, নির্বাচনে মনোনয়নও দিয়েছেন। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করেছেন নারী ভিকটিমদের।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এবং নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতদের স্থায়ী অর্থের উৎস হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পরিবারপ্রতি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার এফডিআর করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর ৬৬ জনকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কয়েক বছর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিনে নিহতের পরিবার ও আহতদের ডেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সাক্ষাৎ করে তাদের সুবিধা-অসুবিধা জেনে চাহিদা পূরণ করেছেন শেখ হাসিনা। পরে নিরাপত্তজনিত কারণে সেটা বন্ধ রাখা হয়।
প্রধানমন্ত্রী ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি দান করে গঠিত বঙ্গবন্ধু মেমেরিয়াল ট্রাস্ট থেকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতদের বিভিন্ন সময় বড় অঙ্কের চিকিৎসা খরচসহ প্রতিমাসে চিকিৎসা ও আহত নিহতদের সন্তানের শিক্ষাবৃত্তি ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
২০০৪ সালে এটি শুরু হয়। এখনও চলছে। অবশ্য ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ট্রাস্ট ব্যাংক হিসাব বন্ধ করলে এই সহযোগিতা সাময়িক বন্ধ ছিল।
জানা গেছে, ওই সময় জেলে থেকেও দলের বিভিন্ন নেতাকর্মীর মাধ্যমে নিহতদের পরিবারের খোঁজ খবর রাখার পাশাপাশি দলের সচ্ছল নেতাদের মাধ্যমে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি।
পরে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সহযোগিতা কার্যক্রম আবারও পুরোদমে চালু হয়।
বর্তমানে গ্রেনেড হামলায় ভিকটিম শতাধিক ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচ বাবদ প্রতিমাসে অনুদান দেওয়া হচ্ছে বলে ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।
অবশ্য ২১ আগস্টের ভিকটিম ছাড়াও অসচ্ছ্বল পরিবার, বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও এই অনুদান দেওয়া হচ্ছে।
অনুদান নিতে আগ্রহী নন এমন অনেককে রাষ্ট্রীয় সফরসঙ্গী করে বিদেশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কাউকে প্রধানমন্ত্রীর কোটা থেকে রাজউকের পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে প্লট দিয়েছেন।
রাজধানীর মিরপুরের ১৫ নম্বরে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে নিহতদের পরিবার ও আহতদের বিনামূল্যে প্রদান করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রী ৩১ জনের কাছে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেন। পরে অন্যদের কাছেও হস্তান্তর করা হয়।
অনুদানের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাস্টের কর্মকর্তা এস এম কামরুল ইসলাম লিটু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসা এবং আহত নিহতদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি হিসেবে প্রতিমাসে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিয়ে থাকেন। জনপ্রতি এর পরিমাণ তিন থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, আগে ২১ আগস্টের ঘটনায় আহত শতাধিক ব্যক্তিকে ট্রাস্ট থেকে চিকিৎসা ও ওষুধ খরচের অনুদান দেওয়া হতো। এদের মধ্যে দুই-তিন জন মারা যাওয়ায় এখন ১০৪ জন এই সহায়তা পাচ্ছেন।
লিটু আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিহতদের পরিবার ও আহতদের নাম ধরে ধরে কে কোথায় কী অবস্থায় আছেন তার সর্বশেষ খবর আমাদের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। কোনও সময় আহতদের কারও চিকিৎসার জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন পড়লেও প্রধানমন্ত্রী তার তহবিলের মাধ্যমে তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন গ্রেনেড হামলায় আহত ও পরে মৃত্যুবরণকারী ধামরাইয়ের সেলিম চৌধুরীর পরিবার। সেলিম চৌধুরীর ছেলে আবদুল্লাহ চৌধুরী তপু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবা বেঁচে থাকতে প্রধানমন্ত্রী তাদের সহযোগিতা করেছেন। তিনি আমাদের মিরপুর ফ্ল্যাট দিয়েছেন। আমরা ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি। আমার এবং আমার বোনের নামে ১০ লাখ করে দেওয়া হয়েছে। আমার বোন এখনও বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।’ তিনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের জন্য যথাসাধ্য করেছেন।
বেঁচে থাকতে সেলিম চৌধুরীর ২২ বার অপারেশনের দরকার পড়েছে উল্লেখ করে তার ছেলে জানান, এসব অস্ত্রোপচারের সময় তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। বাবা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিমাসে ট্রাস্ট থেকে ওষুধ কেনার টাকাও পেতেন তারা।
নিহত মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মী রংপুরের রেজিয়া বেগমের ছেলে নুরনবী জানান, তার পুরো পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। ‘তিনি আমাদের জমি কেনা ও ঘর করার জন্য নগদ টাকা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুদানে একটি গরুর খামার করে আমি ভালো আছি। আমাদের দুই ভাইয়ের নামে এফডিআর করে দিয়েছেন। নগদ অর্থ দিয়েছেন। আমার ও আমার ভাইয়ের সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে পড়াশোনার খরচ পাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য যথেষ্ট করছেন। আমরা যদি বলি বছর বছর আমাদের সাহায্য করা লাগবে সেটা তো ঠিক নয়। যা পেয়েছি তাতেই আমরা খুশি। তবে, আরও খুশি হতাম যদি ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারটা দ্রুত কার্যকর হতো।’
গ্রেনেড হামলায় আহত নাসিমা ফেরদৌসী বলেন, ২১ আগস্ট আহত বা নিহতের পরিবার কাউকেই প্রধানমন্ত্রী ভুলে যাননি। সবাইকে মনে রেখেছেন। ওই ঘটনায় আমার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তিনি পরদিনই আমার পাসপোর্ট ভিসা করিয়ে দিল্লিতে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমত আর তাঁর সহযোহিতায় আজ আমি দু-পায়ে ভর করে হাঁটতে পারছি।
তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নও করেছেন। আমাকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করেছেন। আরও কয়েকজনকে করেছেন। কাউকে দলের পদও দিয়েছেন।
Discussion about this post