এম, সারওয়ার
চলে গেলেন সাবেক শিক্ষাসচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন । বুধবার(২২ এপ্রিল) রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনটি সরকারের সময়ে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব এবং শিক্ষাসচিব হিসেবে এবং স্বরাষ্ট্রসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব (২০০২-০৫ সালে) নিযুক্ত হন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
সা’দত হুসাইন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ এর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে তিনি কাজ করেছিলেন। চাকরী জীবনে তিনি সততা, কর্মদক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিয়মানুবর্তী ও নীতিপরায়ণ একজন সরকারী আমলা।
সা’দত হুসাইন ১৯৪৬ সালের ২৪ নভেম্বর নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন, পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে। ১৯৭০ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগদান করেন।১৯৮৭ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্মজীবন
শিক্ষাজীবন শেষে পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি নড়াইলে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তিনি এপ্রিল মাসে ভারতে যান এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেন।
তিনি ২০০২-২০০৫ মেয়াদে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবে দায়িত্বপালনকালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস থেকে যথারীতি অবসর নেন। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক কমিশনের নবম চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত হন এবং ২০১১ পর্যন্ত এ পদের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছেন। চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রেখেছেন তিনি
ড. সা’দত যখন শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন, তখন সবার জন্য শিক্ষা, বাধ্যতামূলক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা— এই বিষয়গুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা শিক্ষার এসব বিষয় এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।
সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) যুগান্তকারী পরিবর্তন
ড. সা’দাত যেখানে কাজ করেছেন, সেখানেই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর শেষ কাজ ছিল সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) পরিবর্তন আনা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়ে প্রশ্নপত্রফাঁস,অনিয়ম, দুর্নীতিতে পিএসসির ভাবমূর্তি যখন প্রায় শূন্যের কোটায়, তখনই চেয়ারম্যান হিসেবে এর হাল ধরেন তিনি। এতে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ অনেকটাই কমে যায়। পিএসসির স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ফিরে আসে। পিএসসির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তিনি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ওই বছরের মে মাসে তাঁকে পিএসসির চেয়ারম্যান (২০০৭-২০১১) করা হয়। যোগ দিয়েই তিনি ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করেন। শুরু হয় বিতর্ক, যা শেষ হবে না কোনো দিনও। চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করার পর সেই ফল আবার বাতিল করেন। নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নেন। আগের ফলে যাঁরা বাদ পড়েন, তাঁরা মামলা ঠুকে দেন। এতে নতুন ফলাফলে উত্তীর্ণদের নিয়োগ অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। এরপর অবশ্য ২৮, ২৯ ও ৩০তম বিসিএস পরীক্ষায় অনেকটাই নিয়ম–নীতি ফিরে আসে।
বিসিএস পরীক্ষার ধরনটাই পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি । এভাবে তিনি বিসিএস ক্যাডারদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন।ড. সা’দত সব সময় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাইতেন। তাঁর যুক্তি ছিল—সাধারণ ছেলে মেয়েদের মধ্যে মেধাবীরাই যেন সরকারি চাকরি পান। তাঁর সেই স্বপ্ন অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে।
সৃষ্টিশীল কর্মে অগ্রণী
অত্যন্ত সজ্জন ও সত্যবাদী ড. সা’দত হুসাইন টকশোতে ছিলেন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। যেকোনো আলোচকের চেয়ে তার বলার কৌশল ছিলো অনেক জ্ঞান ও তথ্য সমৃদ্ধ।পত্রিকায় তাঁর লেখা নিবন্ধ যারা পড়েছেন তাঁরা বুঝতে পারেন তিনি অনেক বড় মাপের লেখক ও গবেষক ছিলেন।একজন আমলা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের এত কাছাকাছি আসতে পারেন, এটা বিস্ময়কর। তিনি সংবাদপত্রে কলাম লিখেছেন, বই লিখেছেন, টক শো করেছেন। গণমাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন পরিচিত মুখ্। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে তাঁর গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধের দিন-দিনান্ত’। মাওলা ব্রাদার্স থেকে ২০১২ সালে প্রকাশ হয়।
এখনকার আমলা ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য অনেক আদর্শ রেখে গেছেন তিনি। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে দল-মত নির্বিশেষে সকলের নিকটে গ্রহণযোগ্য ব্যাক্তিতে পরিণত হতে হয়।তিনি তার জাগতিক কর্মের মধ্যদিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করেছেন।এই সৃষ্টিশীল মানুষ আরো অনেকদিন তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন। পরম করুণাময় মহান আল্লাহ মরহুম সা’দত হোসাইনকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
Discussion about this post