শাহ মতিন টিপু
শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক একটি অবিস্মরণীয় নাম, এক অসাধারণ ব্যক্তি। মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে শেরে বাংলা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়। জাতি হিসেবে আমরা যে সবাই বাঙালি-এই ঐতিহাসিক সত্যের মূল ভিত্তি তিনিই রচনা করেছেন। এই মহান জাতীয় নেতার ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। জাতি আজ তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।
শেরে বাংলা বাঙালি রাজনীতিবিদ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শেরে বাংলা এবং `হক সাহেব` নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার মধ্যে কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭ – ১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬ – ১৯৫৮) অন্যতম।
বাঙালি জাতির গৌরব উজ্জ্বল নক্ষত্র শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তার মহতি কর্ম ও অবদানের কারণে, তিনি বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। শিক্ষার প্রকৃত আলো জ্বেলে ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে ফুটিয়ে ছিলেন উজ্জ্বল হাসি। বিশেষ করে বাংলার মুসলমান যখন অশিক্ষা, দারিদ্র ও হতাশায় ভুগছে তখন তিনিই নিরলস প্রয়াস চালিয়ে এই অধঃপতিত জাতিকে উদ্ধার করেন। তার কর্মময় জীবনে তিনি শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৪০ সালে শেরে বাংলার প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে তার প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুন্সিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা হয় হরগঙ্গা কলেজ। তার নিজ গ্রামে ও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি এখানে মাদ্রাসা ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তপসিলী সম্প্রদায়ের শিক্ষার জন্য তিনি প্রথম বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন। ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে কলকাতায় লেডি ব্রার্বোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি মুসলমানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন। শিক্ষা বিস্তারে শেরে বাংলার ভূমিকা ছিল অনন্য। বাঙালি মুসলমানদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারে ছিল তার অসামান্য অবদান। শিক্ষা প্রসারের জন্য তার অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
শেরে বাংলার জন্ম ১৮৭৩ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশাল জেলার বানরীপাড়া থানার চাখার গ্রামের কাজী পরিবারে। তার পিতা ওয়াজেদ আলী ছিলেন বরিশালের খ্যাতনামা আইনজীবী। বিপুল ঐশ্বর্যশালী পিতার একমাত্র সন্তান হলেও ফজলুল হক বাল্যকাল থেকেই বহু সদগুণের অধিকারী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তেজস্বিতা, তীক্ষè মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৮৯৭ সালে তিনি বি. এল. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপরই তিনি পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী রূপে ১৯০০ সালে কলকাতা হাই কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু তেজস্বী হক সাহেব সরকারের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯১১ সালে চাকরি ছেড়ে আবার আইন ব্যবসায়ে নেমে পড়েন।
১৯১৮ সালে ভারত মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তার দেওয়া ভাষণ ইতিহাসের এক স্বর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ১৯২৫ সালে তিনি বাংলার মন্ত্রী সভার সদস্য মনোনীত হন।১৯২৭ সালে তিনি কৃষক-প্রজা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৩০-৩১ এবং ১৯৩১-৩২ সালে তিনি বিলেতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। সেখানে তার ব্যক্তিত্বপূর্ণ বক্তৃতা সবার মনে সাড়া জাগায়। ১৯৩৫-৩৬ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন এ পদে অধিষ্ঠিত প্রথম বাঙালি মুসলমান।১৯৩৭ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন। তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসীরা তাকে উপাধি দেয় শের-ই-বঙ্গাল অর্থাৎ বাংলার বাঘ। সে থেকে তিনি শেরে বাংলা নামেই পরিচিত।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকালের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তিনি বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। এ সময়ে তিনি ‘ঋণ সালিশী বোর্ড’ গঠন করেন। এর ফলে দরিদ্র চাষীরা সুদখোর মহাজনের কবল থেকে রক্ষা পায়।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ১৯৫২ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের এডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ‘যুক্তফ্রন্ট’ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর-অব-ল এবং ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁকে ‘হিলাল-ই-পাকিস্তান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সাধনা ছিল তার আজীবনের। তারই প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ, লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ, তার স্বগ্রাম চাখারে ফজলুল হক কলেজ এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
ব্যক্তিগত দানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন হাতেম তাই। তার গোপন দানে কত দুঃস্থ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, কত ছাত্র পরীক্ষার ফি দিয়ে নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিয়েছে, তার দানে যে কত সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কত পীড়িতের দুঃখমোচন হয়েছে তার হিসেব নেই।
বাংলার নয়নমণি শের-এ-বাংলা এ. কে ফজলুল হক ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল প্রায় ৮৯ বছর বয়সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। এ প্রবীণ জনদরদী নেতার মৃত্যু সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলায় নেমে আসে শোকের ছায়া, শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে সমগ্র দেশবাসী। ঢাকার পুরানো হাইকোর্টের পাশে তার মরদেহ সমাহিত করা হয়।
বাঙালি সমাজ যত দিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তাদের হৃদয়ে ফজলুল হক চিরজীবী। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতি বুঝিনে। ওসব দিয়ে আমি ফজলুল হককে বিচার করিনে। আমি তাকে বিচার করি গোঁটা দেশ ও জাতির স্বার্থ দিয়ে। একমাত্র ফজলুল হকই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বাঁচাতে পারে। সে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাচ্চা মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্ব ও সাচ্চা মুসলমানিত্বের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনি।’
Discussion about this post