সৌজন্যে – বাংলা ট্রিবিউন
মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাউয়াদিঘী ও বাইক্কাবিল হাইল হাওরে এবার বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। পাকতে শুরু করেছে ধান। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে শ্রমিক সংকট এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এবার ধান ঘরে তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা। তবে এই দুশ্চিন্তা ঘোচাতে ধান কাটতে মাঠে নেমেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ছাত্র, স্কাউট সদস্য, বেকার যুবকসহ সব পেশার মানুষ এখন ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো মাঠের ধান ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন কৃষকরা।
হাওর এলাকায় ধান কেটে কৃষকদের ঘরে তুলে দিতে উদ্বুদ্ধ করতে কাস্তে হাতে মাঠে নামেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন নিজেই। এছাড়া পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ পিপিএম (বার), পৌর মেয়র মো. ফজলুর রহমান, মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারীসহ অনেকেই।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বেগম নাজিয়া শিরিন বলেন, ‘হাওরে ধান পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু করোনা আতঙ্কে মানুষ ভয়ে ধান কাটতে সাহস পাচ্ছে না। নিজেদের ধান যাতে নিজেরাই কেটে ঘরে আনেন, এজন্য বিভিন্ন হাওরে গিয়ে ধান কাটা পরিদর্শন করি । আমার মনে হয়েছে এতে কৃষকরা একটু উদ্বুদ্ধ হয়েছে। । ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ হাওরের ধান কাটা শেষ হয়েছে। পুরো জেলায় ৫ হাজার শ্রমিক ধান কাটা ও ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এছাড়া ৩৫টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১১৩টি রিফার মেশিন সচল রয়েছে।’
অপরদিকে, কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওরের ভুকশিমইল এলাকায় নানা পেশার মানুষ ধান কাটতে ক্ষেতে নেমেছেন। এ সময় সুলতান আহমদ নামের এক স্কুল শিক্ষকও ধান কাটছেন। তিনি কুলাউড়া উপজেলার রবিরবাজার ইছাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে গ্রামে অনেক মানুষ তার মূল পেশার কাজ করতে পারছেন না। হাওরে উৎপাদিত ধান কাটতে কর্মহীনরা নেমে পড়লে ধান মাঠে পড়ে থাকবে না।’
ভুইকশিমইল এলাকার কৃষক ও ক্ষুদ্র কাপড় ও কসমেটিক্স ব্যবসায়ী সিরাজ আহমদ বলেন, ‘এক মাস থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখন কর্মহীন। হাতে খরচ করার মতো কোনও টাকা নেই। তাই নিজের বর্গা দেওয়া জমির ধান কাটতে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘খরা ও খাল খননের কারণে প্রয়োজনীয় সেচ না দিতে পারায় জমিতে ফলন কম হয়েছে।’
গত ২৩ এপ্রিল থেকে হাকালুকি হাওরপাড়ের বিভিন্ন ক্ষেতে ধান কেটে দিচ্ছেন বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ২৫ এপ্রিল দুপুরে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এমরান হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জুনেদ আহমদের নেতৃত্বে শতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী হাকালুকি হাওরের মুর্শিবাদকুরা গ্রামের কৃষক মনোরঞ্জন বিশ্বাসের তিন বিঘা ধান কেটে দেন। পর্যায়ক্রমে তারা বিভিন্ন এলাকার কৃষকের ধান কেটে দেবেন বলে জানিয়েছেন।
কৃষক ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘শ্রমিক সংকটে পাকা ধান কাটতে পারছিলাম না। ঝড় হলে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবে, তাই চিন্তায় ছিলাম। বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে তারা ধান কেটে দেওয়ায় আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
অন্যদিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৯ হাজার ৪১২ হেক্টর হাওর এলাকায় ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর এবং সমতলে ৫ হাজার ৭৬২ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চলের প্রায় ৪৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন মোনালিসা সুইটি বলেন, ‘২০১৯ সালে বোরো ধানের মোট উৎপাদন হয়েছিল ৩৫ হাজার ৬৮২ মেট্রিক টন। এবার আমরা লক্ষ্যমাত্রা ধরেছি ৩৮ হাজার মেট্রিক টনের কাছাকাছি। আশা করছি, উৎপাদন ৪৫ হাজার মেট্রিক টনের ওপরে হবে।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চলমান করোনা যুদ্ধে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বোরো ধান। আমরা চেষ্টা করছি, ক্ষেতের শতভাগ ধানই ঘরে তুলতে।’
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারী জানান, বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৫৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে হাওরে আবাদ হয়েছে ২৬ হাজার ৭৫৪ হেক্টর জমিতে। ইতোমধ্যে মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাউয়াদিঘি ও বাইক্কাবিল হাইল হাওরে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। জেলায় লকডাউন অবস্থায় বেকার পরিবহন শ্রমিক, চা শ্রমিকসহ প্রায় ২৩ হাজার ১৪৭ জন শ্রমিক ধান কাটার কাজ করছেন। এছাড়া ২৩টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৪৭টি রিফার মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। বর্তমানে আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। এ মাসের মধ্যেই হাওরের ধান ঘরে তোলা সম্ভব। আউস, আমন ও বোরো ধান মিলিয়ে জেলায় আবাদ হয়ে থাকে প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ ৯৬ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে। আউস মৌসুমে এ জেলায় অনেক জমি অনাবাদি থাকে। চলতি আউস মৌসুমে স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে চাষের আওতা বৃদ্ধিতে জোর চেষ্টা করা হবে।
Discussion about this post