নিউজ ডেস্ক
‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে কোনভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। বরং মনে সাহস রেখে চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত গরম পানি খেতে হবে। গরম পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে ঘন ঘন কুলকুচি করতে হবে। ’ -কথাগুলো বলছিলেন বগুড়া জেলার প্রথম করোনাজয়ী পুলিশ কনস্টেবল আহসান হাবিব।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) কর্মরত আহসান হাবিব গত ৮ এপ্রিল বগুড়ার আদমদীঘির সাঁওইল গ্রামে নিজ বাড়িতে আসেন। ঢাকাফেরত হিসেবে সেদিন থেকেই তাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। তবে হালকা জ্বর-কাশি থাকায় ১৩ এপ্রিল তিনি নিজ উদোগে আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নমুনা পরীক্ষা করাতে যান। তিনদিনের মাথায় ১৬ এপ্রিল রাতে রিপোর্ট আসে তিনি করোনা পজেটিভ।
ওইদিন রাতেই তাকে আইসোলেশন ইউনিট বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেখভাল করার জন্য সঙ্গে আনা হয় তার স্ত্রী ফাহমিদা বেগমকেও। নিয়ম অনুযায়ী গত ২১ এবং ২৩ এপ্রিল আবারও তার এবং সঙ্গে থাকা স্ত্রীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পর পর দু’টি পরীক্ষায় নেগেটিভ আসায় ২৫ এপ্রিল বেলা ৩টার দিকে আহসান হাবিবকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরে যান।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে করোনাজয়ীর তালিকায় আহসান হাবিবের নাম দ্বিতীয় ক্রমিকে রাখা হয়েছে। কারণ তার আগের দিন ২৪ এপ্রিল বিকেলে করোনামুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যান রংপুরের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ শাহ্ আলম। তবে শাহ্ আলমের বাড়ি যেহেতু রংপুরে সে কারণে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে তার পরিবর্তে আহসান হাবিবকেই বগুড়ার প্রথম করোনা রোগী হিসেবে হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বগুড়ায় করোনা পজেটিভ ১৫ জনের মধ্যে বর্তমানে ওই হাসপাতলে ছয়জন চিকিৎসাধীন। বাকি নয়জনকে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে আলাদা কক্ষে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
করোনাকালের কষ্টের কথা জানতে চাইলে ২৯ বছর বয়সী আহসান হাবিব সমকালকে বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে আমার যতটা না খারাপ লেগেছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি নিজ এলাকার মানুষের আচরণে। করোনা পজেটিভ শোনার পর তারা আমার বাড়িতে মল ছুঁড়ে মেরেছে। এমনকি আমার মায়ের গায়ে হাত তুলতেও তারা দ্বিধা করেনি।’
অবশ্য আন্তরিকতা নিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়ায় তিনি করোনা আইসোলেশন ইউনিট বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. শফিক আমিন কাজলের প্রশংসা করেছেন। আর নিজ বাহিনীর অভিভাবক হিসেবে সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঁইয়ার প্রতিও।
আহসান হাবিব জানান, হাসপাতালে তাকে অ্যাজিথ্রোমাইসিন (জিম্যাক্স), মন্টিলুকাস্ট (মন্টিকাশ), প্যারাসিটামল ও গ্যাসট্রিকের ওষুধ সেবন করতে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই আমার জ্বর ছিল তাই আগের চিকিৎসকের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী আমি ডোকোপা (ডক্সোফাইলিন), ফেনাডিন (ফেক্সোফেনাডিন) নাপা (প্যারাসিটামল) ও গ্যাসট্রিকের ওষুধ খেয়েছি। এগুলো শেষ হলে হাসপাতাল থেকে দেওয়া ওষুধগুলো খেয়েছি।’
ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত গরম পানি পান করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সহকর্মীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে নিয়মিত গরম পানি খেতে এবং গরম পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে গারগিল করার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি ঘন ঘন গরম পানি খেয়েছি এবং গারগিল করেছি।’
এলাকাবাসীর আচরণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। গ্রামে আসার পর থেকে আমি বাড়ির বাইরে যাইনি। শুধু একদিন আমি হাতে গ্লাভস পরে মোটরসাইকেল নিয়ে ওষুধের দোকানে গিয়েছিলাম। সেখানে ৩ ফুট দূর থেকেই ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু যখন আমার রিপোর্ট পজেটিভ আসলো তখন গ্রামের লোকজন নানাভাবে নির্যাতন শুরু করলো। আমি আইসোলেশন সেন্টারে যেতে রাজি হওয়ার পরও তারা লাঠিসোটা নিয়ে আমার বাড়ি ঘেরাও করলো। এক পর্যায়ে তারা আমার বাড়িতে মল ছোড়া শুরু করলো এবং আমার মায়ের গায়ে হাতও তুললো।
ওইদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শহিদুল্লাহ্ দেওয়ান জানান, পুলিশ কনস্টেবল আহসান হাবিব বগুড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি ছিলেন। কিন্তু তারপরেও গ্রামের লোকজন নিজেরা সংক্রমিত হওয়ার ভয় থেকে বার বার উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। পরে আমরা তাদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করি।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. শফিক আমিন কাজল জানান, পুলিশ কনস্টেবল আহসান হাবিবকে তারা যথাযথ চিকিৎসা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আহসান হাবিব মানসিকভাবে খুবই শক্ত ছিলেন। যে কারণে তাকে চিকিৎসা দিতে আমাদের কোন সমস্যা হয়নি।’
বর্তমানে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা পজেটিভ ছয় রোগীর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা ভাল আছেন এবং দিন দিন তাদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
Discussion about this post