শিক্ষার আলো ডেস্ক
সংঘবদ্ধ একটি চক্র পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে হাজারো শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
চক্রের অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্য বিগত প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এরমধ্যে অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়েছেন!
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি বলছে, এই চক্রে অন্তত ৮০ জন রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই চিকিৎসক ও কোচিং সেন্টারে যুক্ত। ১৬ বছর ধরে তারা প্রশ্ন ফাঁস করে আসছে।
প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত সন্দেহে গত কয়েক দিনে ১২ জনকে গ্রেপ্তারের পর রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত ৭ চিকিৎসকসহ প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে।
তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপি ও ১ জন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে বিভিন্ন সময় যুক্ত ছিলেন। এদের ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো মানিলন্ডারিং মামলায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদের সাতজনই চিকিৎসক। প্রায় সবাই বিভিন্ন ভর্তি কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করতেন। আটজন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে সিআইডি জানায়।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে প্রশ্নফাঁস চক্রটির অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্যের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। তারা ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার প্রশ্নফাঁস করেছেন।
তিনি জানান, গ্রেপ্তার ১২ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রেপ্তার চিকিৎসকরা হলেন- ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (৫০), সোহেলী জামান (৪০), মো. আবু রায়হান, জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮), জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮), জিল্লুর হাসান রনি ও ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২)।
গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- জহির ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩), জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫) ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম বলেছেন, যারা প্রশ্ন পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। অনেকে পাস করে চিকিৎসকও হয়ে গেছেন।
অবৈধভাবে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদেরও আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে জানিয়ে সিআইডি প্রধান বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক ব্যাংক চেক ও অ্যাডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এই চক্রের ‘হোতা’ জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, তিনি এখনও কারাগারে আছেন।
অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী জানান, জসীমের কাছ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছিল। সেখানে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্য সদস্যদের নাম রয়েছে। তাদের ধরতে সিআইডির অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এ ঘটনায় নাম এসেছে মেডিকো ভর্তি কোচিং, ই-হক কোচিং সেন্টার, ফেইম কোচিং, প্রাইভেট কোচিং সেন্টার, থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টার, ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামের একটি ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র এবং প্রাইমেট নামের একটি ভর্তি কোচিংয়ের নাম। সিআইডি জানিয়েছে, মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ের আড়ালে নানা সময়ে এসব প্রশ্ন ফাঁস করেছে চক্রটি।
মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, পাবলিক পরীক্ষা সামনে এলেই চক্রটি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই চক্র নানান কায়দায় প্রশ্নফাঁস করে, পাশাপাশি গুজব ছড়িয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে। শিক্ষাখাতের ক্যান্সার হিসেবে বিবেচিত এসব প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রকে নির্মূল করতে কাজ করছে পুলিশ।
গ্রেপ্তার কারা কারা
এবার গ্রেপ্তার ময়েজ উদ্দিন আহমেদকে চক্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে দেখাচ্ছে সিআইডি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ‘ফেইম কোচিং সেন্টার’র মাধ্যমে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান।সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী বলেন, “তিনি প্রশ্ন ফাঁস ও মানি লন্ডারিং দুই মামলাতেই এজাহারভুক্ত আসামি। তিনি ছাত্রশিবির নেতা থেকে পরবর্তীতে জামায়তের ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পান।”
গ্রেপ্তার সোহেলী জামান ময়েজ উদ্দিনের স্ত্রী। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক সোহেলী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ‘ফেইম কোচিং সেন্টার’ এর মাধ্যমে তিনি এই চক্রে জড়ান বলে সিআইডির ভাষ্য।
গ্রেপ্তার আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ওই কলেজে ভর্তি হয়ে এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বলে সিআইডি জানাচ্ছে। তিনি ‘প্রাইমেট কোচিং সেন্টার’ চালাতেন। এখন কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়গনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক হিসেবে রয়েছেন।
সালেহীন শোভন মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ‘থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টার’ র মাধ্যমে তিনি এই চক্রের সঙ্গে জড়ান বলে সিআইডির ভাষ্য। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ। ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের নেতা ছিলেন তিনি।
গ্রেপ্তার জোবাইদুর রহমান জনি ‘মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টার’র মালিক এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদকও হন।সিআইডি বলছে, ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়ান জনি। নামকরা বিভিন্ন চিকিৎসকের সন্তানদের চান্স পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে জনি প্রশ্ন ফাঁস করে বাড়ি-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন।
জিল্লুর হাসান রনি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক। ২০০৫ সাল থেকে তিনি এই চক্রে জড়িত বলে সিআইডির দাবি। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রনি। রংপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্রদল নেতা রনি এখন বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)’ এর সঙ্গে যুক্ত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত টিমের একজন চিকিৎসক।
গ্রেপ্তার ইমরুল কায়েস হিমেল তার বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান বলে সিআইডির ভাষ্য। তার শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইলে। ২০১৫ সালে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে মেডিকেলে ভর্তি করানোর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
জহির ইসলাম মুক্তার চক্রের ‘মাস্টারমাইন্ড’ জসীমের বড় ভাই এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাত ভাই। সিআইডি বলছে, তিনি নিজেই আলাদা একটি চক্র চালাতেন। আদালতে ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
রওশন আলী হিমুকে জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখিয়েছে সিআইডি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের ছাত্র হিমু ২০০৬ সাল থেকে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত বলে অভিযোগ।
আক্তারুজ্জামান তুষার মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ‘ই-হক কোচিং সেন্টার’ চালাতেন তিনি। সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত তিনি। ২০১৫ সালে রাবের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।
জহির উদ্দিন বাপ্পী ঢাকার ফার্মগেইটের ‘ইউনিভার্সেল’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। সিআইডি বলছে, ‘প্রাইমেট থ্রি ডক্টরস’সহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে দেড় যুগ ধরে প্রশ্ন সরবরাহ করতেন ।
আব্দুল কুদ্দুস সরকার টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। ২০০৬ সালে মেয়েকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান জানিয়ে সিআইডি বলছে, এরপর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে প্রশ্ন ফাঁসের ‘সিন্ডিকেট’ গড়েন। সিআইডি জানিয়েছে, জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল যেতেন।
Discussion about this post