শিক্ষার আলো ডেস্ক
প্রায় সব শিক্ষার্থী কোনো না কোনো বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী। পাবলিক পরীক্ষায় খারাপ ফল করার কারণে এমন অনেক শিক্ষার্থীর মেধা ও দক্ষতা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে না। ঝরে পড়ে অনেক মেধাবীরাও। এতদিন ধরে চলা শিক্ষাক্রমে যা ‘অতি বড় সংকট’ বলে বিবেচিত। প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমে এমন সংকট থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনার চেষ্টা করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এ লক্ষ্যে এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন বাদ দেওয়া হচ্ছে। থাকছে না দুই যুগ ধরে প্রচলিত জিপিএ পদ্ধতিও। সমাপ্তি ঘটছে জিপিএ-৫ কিংবা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়ার যুদ্ধেরও। এখন থেকে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নে ব্যবহার হবে পারফরম্যান্স ‘ইনডিকেটর’, অর্থাৎ বিশেষ পারদর্শিতার ‘চিহ্ন’। ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দিয়ে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন শুরু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, ফল হিসেবে যে ইনডিকেটর বা চিহ্ন দেওয়া হবে, তা থেকে বোঝা যাবে- কোন শিক্ষার্থী কোন বিষয় বা কাজে বেশি দক্ষ। ‘ভালো’, ‘মধ্যম’ বা ‘খারাপ’ ফল বলে কোনো কথা বা বার্তাও সেখানে থাকবে না। কোনো শিক্ষার্থী খেলাধুলায় পারদর্শী হতে পারে, কেউ হতে পারে ছবি আঁকায়। কারও কথা বলার দক্ষতা বেশি থাকতে পারে। তাদের এসব দক্ষতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ পছন্দ করে পড়তে উৎসাহ দেওয়া হবে। এতে শিক্ষার্থী যে বিষয়ে দক্ষ ও আগ্রহী, সে বিষয়ে পড়বে এবং কর্মজীবনে সেই ক্ষেত্রেই কাজ করবে। চাকরির বাজারে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ কর্মী বাড়লে, কমবে বেকারত্বও।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জিপিএ পদ্ধতি যে থাকছে না, এটা আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হবে, সেটা নিয়ে আমাদের শিক্ষাক্রম প্রণেতারা কাজ করছেন। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভালো একটা মডেল দাঁড় করাবে বলে আশা করছি। ২০২৫ সালের আগেই আমরা এটাকে কাঠামোভিত্তিক মডেলে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করবো।’
কেউ গোল্ডেন জিপিএ-৫ (সব বিষয়ে ৮০ নম্বরের ওপরে) পেলে তাকে সবচেয়ে মেধাবী বলে বিবেচনা করা হয়। আবার কেউ জিপিএ-৪ বা ৩.৫ পেলে তাকে ততটা মেধাবী নয় বা ফল ভালো হয়নি বলে বিবেচনার সংস্কৃতি বিদ্যমান। এটিকে ‘নন-সেন্স’ ও ‘ইডিয়টিং’, অর্থাৎ ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ ও ‘নির্বুদ্ধিতা’ বলে মনে করেন নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করা অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য।
নম্বর বলে কোনো শব্দ থাকবে না উল্লেখ করে ড. মশিউজ্জামান বলেন, ‘শিশু-কিশোর-তরুণদের আমরা মূল্যায়ন করবো, পরীক্ষার মুখে ফেলবো না। পরীক্ষা নিয়ে দেওয়া হয় নম্বর। আর মূল্যায়নে জানানো হবে পারফরম্যান্স, তার অ্যাক্টিভিটি, তার আগ্রহ। প্রত্যেক বিষয়ের পাশে পারফরম্যান্স ইনডিকেটর (পারদর্শিতা চিহ্ন) থাকবে, তার বিপরীতে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থান কোথায়, সেটা চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হবে। এখন যেমন লেখা হয়- বাংলায় ৭০ নম্বর বা এ গ্রেড, ইংরেজিতে ৮০ নম্বর বা এ প্লাস গ্রেড, এসবের কিছুই থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আমরা ষান্মাষিক মূল্যায়ন করেছি। এখানে তিনটি ইনডিকেটর বা চিহ্ন ছিল। ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চর্তুভুজ। এটা দিয়ে আমরা খুব ভালো, মধ্যম ও খারাপ বোঝাইনি। এগুলো অনেকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে ছড়িয়েছে। সিম্বলগুলো দিয়ে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার মাত্রা নয় বরং কোনদিকে কার পারফরম্যান্স কেমন, তা বোঝানো হয়েছে। আমরা ভাবছি- আগামী বছর এ চিহ্নগুলো উলট-পালট করে দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার প্রাথমিক থেকেই শিক্ষার্থীর দক্ষতা নির্ণয় করবো এবং তা বাতলে দেবো। শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে আগ্রহী ও দক্ষ তা তার মননে গেঁথে দেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড় হবে। মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে তাকে এমন একটা বোঝাপড়ার জায়গায় আমরা নিতে চাইবো- যেখান থেকে সে নিজেই নিজের ক্যারিয়ার বেছে নেবে।’
অন্যদিকে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে নানান উদ্যোগ নিলেও সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না অভিভাবকদের। পরীক্ষা ও নম্বরবিহীন কারিকুলাম নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দানা বাঁধছে। চিহ্নভিত্তিক মূল্যায়নে কোনো আস্থা ও যৌক্তিকতা দেখছেন না অভিভাবকরা।
অভিভাবকদের এমন ‘উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা’ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাক্রম প্রণেতাদের একজন অধ্যাপক মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তার মানে অভিভাবকরা সচেতন। তারা সন্তানের খারাপ চান না। আমরাও সেই লক্ষ্যে নতুন শিক্ষাক্রম করেছি। যাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের খারাপ না হয়, ভালোটা হয়। অভিভাবক সচেতন হয়ে এটা নিয়ে আলাপ তুললে আলোচনা করা এবং বোঝানো সহজ হবে। আমার বিশ্বাস- তাদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হবো ও তারা শিক্ষাক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন।’ সুত্র- জাগো নিউজ
Discussion about this post