ফারুক আহমাদ আরিফ
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের একাত্তর বছর পার করেছে ২০২৩ সালটি। সে সময় যেসব ছাত্র-যুবক রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন, তাদের অনেকে বিভিন্ন সময় বার্ধক্যজনিত কারণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
এখনও যে কজন জীবিত আছেন, বয়সের ভারে তারা ন্যুব্জ। তাদের মধ্যে অন্যতম আহমদ রফিক, অধ্যাপক আব্দুল গফুর, প্রকৌশলী সাবির আহমেদ চৌধুরী, গোলাম আরিফ টিপু, মুস্তাফা মনোয়ার, শামসুল হুদা, শরিফা খাতুন, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, আবদুল আজিজ ও অধ্যক্ষ মাসউদ। বয়সের কারণে নিজ ঘরেই কাটে তাদের সময়। বাইরে বা অনুষ্ঠানে বেশি একটা যাতায়াত করতে পারেন না।
আহমদ রফিক : দেশের একজন অগ্রগণ্য মুক্তমনা ব্যক্তিত্ব, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। এ কারণে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে তাকে। মেডিকেল কলেজ তার ছাত্রত্ব স্থগিত রেখেছিল। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ছাত্রত্ব ফিরে পেয়েছিলেন। ৯৪ বছর বয়সি আহমদ রফিক ঢাকায় নিজ বাসাতেই অবস্থান করছেন। এখনও সক্রিয় আছেন লেখালেখিতে। নিজের সম্পত্তি বলতে যা ছিল সব মানুষের কল্যাণে ও শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে দান করে দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় ১৯৯৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।
সাবির আহমেদ চৌধুরী : এই ভাষাসংগ্রামীর বয়স এখন ৯৯ বছর। জন্ম ১৯২৪ সালে নরসিংদীর মনোহরদী থানার (বর্তমানে বেলাব) হাড়িসাংগান গ্রামে। তিনি পেশায় প্রকৌশলী। মরমী গীতিকবি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে তার।
আহসানিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ালেখার সময় ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সাবির আহমেদ চৌধুরী। ১৯৫১ সালের শেষ দিকে চাকরিজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকায় ছিলেন না। তবে আন্দোলনের খোঁজখবর রাখতেন; বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। ১৯৫২ সালে ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি করেছে জানতে পেরে কয়েক দিনের ব্যবধানে ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান। মিছিলে অংশ নেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আন্দোলনে নানাভাবে সক্রিয় ছিলেন
বর্তমানে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি তার বাসায় গেলে স্ত্রী নার্গিস চৌধুরী জানান, ‘সাবির আহমেদ চৌধুরীর গত জানুয়ারি প্রথম সপ্তাহে হার্ট অ্যাটাক করে মাসখানেক হাসপাতালে ছিলেন। ডানপাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। ৬ ফেব্রুয়ারি তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। কথাবার্তা বেশি একটা বলতে পারেন না। আল্লাহর রহমতে এখন কিছুটা সুস্থ।’
শামসুল হুদা : ভাষা আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শিক্ষার্থীদের ১০ জন ১০ জন করে যে মিছিল বের হয়েছিল তার মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় দলে। ৯১ বছর ১০ মাস বয়সি শামসুল হুদা এখন কোথাও যাতায়াত করতে পারেন না। ঢাকার আদাবরের বাসাতেই অবস্থান করছেন। ২০১৪ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
অধ্যাপক শরিফা খাতুন : ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ইডেন কলেজে পড়ালেখা করার সময়েই। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা ও শিক্ষকতা করেছেন। ২০১৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তার স্বামী প্রয়াত বিচারপতি এবাদুল হকও ভাষাসংগ্রামী ছিলেন। অধ্যাপক শরিফা খাতুন এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। ধানমন্ডিতে নিজের বাসাতেই অবস্থান করছেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি তার বাসায় উপস্থিত হলে তিনি জানান, তিনি কিছুটা সচল থাকলেও বাইরে বেশি একটা যান না। কোনো অপ্রাপ্তি আছে কি না জানতে চাইলে হাসিমুখে বলেন, ‘না, কোনো অপ্রাপ্তি নেই। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। জীবনে সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছি। জাতির কাছে আর কিছু চাই না।’
অধ্যাপক আব্দুল গফুর : প্রখ্যাত সাহিত্যিক শাহেদ আলীর মাধ্যমে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা, ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাশেমের সঙ্গে পরিচয় এবং সেই সূত্রে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় তিনি অধ্যাপক আবুল কাশেমের সহকারী হিসেবে পত্রিকা সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গে একবার এক সাক্ষাৎকারে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের পাশেই) শিক্ষার্থীদের সমাবেশে পুলিশ গুলি করার পর আন্দোলনে ভিন্নমাত্রা পায়। পরবর্তী সময়ে পুলিশ সৈনিক পত্রিকার অফিসে গ্রেপ্তার অভিযান চালায়। তখন তিনি অধ্যাপক সাহেবের সঙ্গে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যান।
২০০৫ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ৯৪ বছর বয়সি আব্দুল গফুর বর্তমানে একটি হাসপাতালে চিকিৎসারত। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ছেলে সাংবাদিক তারেক আল বান্না বলেন, ‘আব্বা বার্ধক্যজনিত কারণে তায়াম্মুম, সালাত, খাওয়া-দাওয়া বিছানাতেই সবকিছু করেন। তার সোডিয়াম কমে যাওয়ায় কয়েক দিন আগে বনশ্রীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্মৃতিশক্তি তেমন একটা নেই।’
গোলাম আরিফ টিপু : ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে বাংলা ভাষা আন্দোলন মূলত তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পেশায় আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির দায়িত্বে আছেন। ২০১৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ৯২ বছর বয়সি গোলাম আরিফ টিপুর সময় কাটে ঢাকার বাসাতেই। তার বাসায় ফোন দিলে স্বজনরা জানান, তিনি বাইরে বেশি একটা বের হতে পারেন না।
প্রতিভা মুৎসুদ্দি : ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’Ñ এই বক্তব্যের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে সেখানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ২০০২ সালে একুশে পদক পান তিনি। প্রতিভা মুৎসুদ্দি বর্তমানে টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কমপ্লেক্সের প্রশাসক ও পরিচালক হিসেবে কর্মরত। কুমুদিনী কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা প্রহ্লাদ পণিক প্রলয় জানান, ৮৯ বছর বয়সি প্রতিভা মুৎসুদ্দি সুস্থ আছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটিতেই থাকেন।
মুস্তাফা মনোয়ার : দেশবরেণ্য এ চিত্রশিল্পী নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন ভাষা আন্দোলনের কথা শোনেন। ঢাকায় গুলি হয়েছে, বাঙালি শহীদ হয়েছে, পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষা বন্ধ করে দিতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে ছবি আঁকতে শুরু করেন এবং সেই ছবি বন্ধুদের সঙ্গে সারা নারায়ণগঞ্জ শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেন। যার ফলে পুলিশ তার দুলাভাইসহ তাকে বন্দি করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ২০০৪ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয় আছেন।
আবদুল আজিজ : ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি করার সংবাদ ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেটে পৌঁছালে এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিক) পরীক্ষার্থী আবদুল আজিজ ছাত্রদেরকে নিয়ে ধর্মঘট শুরু করেন। এ আন্দোলন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। যোগ দেয় সাধারণ মানুষও। ২৫ ফেব্রুয়ারি স্কুল কমিটি ও রাজনীতিবিদদের সহযোগিতায় স্থানীয় বাজারে সভা করে পত্রপত্রিকার সংবাদগুলো চোঙ্গার মাধ্যমে পড়ে শোনাচ্ছিলেন তিনি। এতে সাড়া পড়ে ব্যাপক। ফলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। বাধ্য হয়ে গা ঢাকা দেন তিনি। সিলেটের ভাষা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল আজিজ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে। ৮৭ বছর বয়সি আবদুল আজিজ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রফেসর ইমিরেটাস।
অধ্যক্ষ মাসউদ : তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব ছিল রাজনীতি সচেতন মাসউদের ওপর। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় ধর্মঘট পালন করে শিক্ষার্থীদের মিছিল নিয়ে প্রতিদিন সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কে সমাবেশে যোগ দিতেন তিনি। পরবর্তী সময়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে তাকে নিয়োগ দেন। এ ভাষাসংগ্রামী একাধারে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, আইনবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। সিলেটে বেঁচে থাকা ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে তিনিও একজন।
Discussion about this post