ডিজিটাল প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল। সে জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে এ দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা যায় সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সরকারের রূপকল্প-২০২১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ (এসডিজি) ও রূপকল্প-২০৪১, ৭১, ২১০০ এর লক্ষ্যসমূহ অর্জন এবং বৈশ্বিক পরিবর্তনশীলতাকে ধারণ করতেই ডিজিটাল প্রযুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে আমরা ব্যবহার করব।
আমরা সবাই জানি সামনের বছরটা আমাদের মুজিববর্ষ। এই বছরজুড়ে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করব। তার পরের বছর ২০২১ সাল আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর। সেই সময়টা আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ারও সময়। এরই মাঝে ২০১৮ সালে একটি নির্বাচন অতিক্রম করে একটি নতুন সরকার ধারাবাহিকভাবে তার তৃতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে। এই সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। মাত্র কয়েক মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনই সম্ভবত একটু মূল্যায়ন করা দরকার যে ২০২৩ সালে আমরা কোথায় থাকব। কোথায় থাকবে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ? কোনো সন্দেহ নেই যে ২০২৩ সালে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ২.০ এ বসবাস করব। ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম সিঁড়িটি পার করে আমরা এর দ্বিতীয় সংস্করণে পা রাখব। এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে ২০০৮ সালে ঘোষিত কর্মসূচির সমাপ্তি ২০২১ সালেই সমাপ্ত হবে। বস্তুত সেটিকে আমরা প্রাথমিক স্তর হিসেবে চিহ্নিত করি। ২০২৩ সাল তাই আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির দ্বিতীয় ধাপের মাঝেই পড়বে। এরপর আমাদের সামনে ৩০-৪১, ৭১ ও ২১০০ সাল আসবে। ততদিনে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ দ্বিতীয় তো বটেই, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বা তারও পরের স্তর পার করবে। হয়তো তখন জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ কর্মসূচির স্তরও পার করে যাব। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ’৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ১৩ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেই ঘোষণা করেছেন।
সারা বিশ্ব বস্তুত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে মাতম করছে। প্রযুক্তিতে ৩২৪ বছর পিছিয়ে পড়া বাঙালি প্রথম তিনটি শিল্পযুগ মিস করেছে। চতুর্থ বা ডিজিটাল শিল্পবিপ্লব মিস করে সেই একই ভুল আমরা আবারো করতে পারি না। সেই সচেতনতা আমাদের রয়েছে বলেই এবার আমরা বিশ্ববাসীর সবার আগে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মর্মবাণী উচ্চারণ করতে পেরেছি। আমাদের জন্য এটি গর্ব করে স্মরণ করার বিষয় যে, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা এই রূপান্তরের ঘোষণায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। আমাদের আগে বিশ্বের কোনো দেশ পুরো দেশটাকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বদলে দেয়ার কথা ভাবেনি। আমাদের পরে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটেন ও ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট ভারত আমাদের পথ অনুসরণ করে। ২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলে। এখন অবশ্য দুনিয়ার সব দেশই আমাদের পথ ধরে চলছে। যদিও জাপান-কোরিয়া বহুদিন থেকেই ইউবিকুটাস দেশ হিসেবে তাদের গড়ে তোলার কথা বলে আসছিল বা শ্রীলঙ্কা, রুয়ান্ডা ই-লঙ্কা, ই-রুয়ান্ডা স্লোগান দিচ্ছিল তবুও ডিজিটাল যুগের প্রকৃত আপ্তবাক্যটি তারা কেউ উচ্চারণ করতে পারেনি। আমাদের সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি ও জীবনধারায় কৃষিযুগের পশ্চাৎপদতার বদলে দুনিয়াকে ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দেয়া। আমাদের জন্য স্বপ্নের স্তরগুলো হচ্ছে মুজিববর্ষ ২০২০, ডিজিটাল বাংলাদেশ বর্ষ ২০২১, এসডিজি বর্ষ ২০৩০, উন্নত বাংলাদেশ বর্ষ ২০৪১, স্বাধীনতার শতবর্ষ ২০৭১ ও ২১০০ সালের বদ্বীপ পরিকল্পনার রূপকল্প বাস্তবায়ন করার সময়।
আমাদের আঁকতে হচ্ছে এমন একটি পথনকশা যাতে আমরা আমাদের ২০, ২১, ৩০, ৪১, ৭১ ও ২১০০ সালের রূপকল্পকে বাস্তবায়ন করার বিবরণ পেতে পারি। এখনকার সময়ে অবস্থান করে, ২০-২১, ৩০, ৪১, ৭১ বা ২১০০ সালের অবস্থাটি যে কারো জন্য আন্দাজ করা একদমই দুরূহ। এমনকি ২০-২১ সালে আমরা কেমন পৃথিবীতে বাস করব সেটিও অনুমান করা কঠিন। তবুও আমরা কিছু মৌলিক ও কৌশলগত বিষয় চিহ্নিত করে একটি কর্মপরিকল্পনার প্রাথমিক রূপরেখা তৈরির কথা ভাবতে পারি। যেসব মৌলিক উপাদান আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে সেগুলোর মাঝে রয়েছে দেশের সব মানুষের জন্য ডিজিটাল সংযুক্তি, ডিজিটাল যুগের দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠা ও শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য-কৃষির ডিজিটাল রূপান্তর। আমরা মনে করি, এর ফলে আমাদের জনগণ একটি ডিজিটাল জীবনধারায় বসবাস করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, ডিজিটাল অর্থনীতি, সৃজনশীল সমাজ বা মেধাভিত্তিক শিল্পযুগ গড়ে তোলার প্লাটফরম রচনা করবে সেটিও আমরা লক্ষ্য হিসেবে স্থির করতে পারি। আমরা দেশটিকে ডিজিটাল অর্থনীতি, সৃজনশীল অর্থনীতি, মেধাভিত্তিক শিল্পযুগ বা সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্তত পাঁচটি সময়কালসমূহের ধাপগুলো সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। এ কথাটি খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর দেশটিতে সব স্তরে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটতে শুরু করে। তৃণমূলের সাধারণ মানুষ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বোচ্চ স্তর অবধি এই বিপ্লব এখন বহমান।
এক দশকের রূপান্তর: ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর এক দশকে আমাদের যে অর্জন তার সঙ্গে ২০-২১, ৩০, ৪১, ৭১ বা ২১০০ সালের স্বপ্নকে রূপরেখায় পরিণত করে আমরা আমাদের একাদশ সংসদের সময়কালের গন্তব্যটা স্থির করতে পারি। এই সময়ের বিশ্ব সভ্যতার রূপান্তর, বিগত সময়কালে আমাদের নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান প্রযুক্তির সঙ্গে আগামী দিনের প্রযুক্তিকে বিবেচনায় রেখে সামনে চলতে হবে। বস্তুত ২০০৮ সালের ঘোষণা এবং ২০০৯ সাল থেকে এক দশক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অনবদ্য প্রচেষ্টাকে বিবেচনায় রেখে ডিজিটাল রূপান্তরে বিপুল কর্মযজ্ঞ আয়োজিত হয়েছে এবং চলমান রয়েছে। সমগ্র দেশে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ, ৪জির প্রবর্তন, ৫জির পরীক্ষা, জনগণের হাতে সরকারি সেবা পৌঁছানো তথা সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানবসম্পদ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ডিজিটাল শিল্পের বিকাশ ও জনগণের জীবনযাপনের মানোন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এই নীতিমালা অসাধারণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা বিবেচনায় রেখেছি যে, ডিজিটাল প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল। সে জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে এ দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা যায় সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সরকারের রূপকল্প-২০২১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ (এসডিজি) ও রূপকল্প-২০৪১, ৭১, ২১০০ এর লক্ষ্যসমূহ অর্জন এবং বৈশ্বিক পরিবর্তনশীলতাকে ধারণ করতেই ডিজিটাল প্রযুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে আমরা ব্যবহার করব। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলব আমরা।
প্রথমেই আমরা একটু তাকিয়ে দেখতে পারি গত দশ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্জন কেমন ছিল। একবাক্যে আমরা এটি বলতে পারি যে, ২০২১ সালে গড়ে তোলা ডিজিটাল বাংলাদেশ দুই বছর আগেই সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। মোবাইলের যুগটা ৩জি প্রযুক্তির পর ৪জিতে পৌঁছাল। এমনকি ৫জি প্রযুক্তি পরীক্ষাও করা হলো। মোবাইল প্রযুক্তিকে আরো সুরক্ষিত করতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধিত হচ্ছে। কাগজের সিম নিবন্ধন ডিজিটাল হয়েছে। এরই মাঝে ৫ হাজার ৭৩৭টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার এবং ৮২০০ ডিজিটাল ডাক কেন্দ্রের মাধ্যমে তৃণমূলের জনগণকে অন্তত ৩০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। দেশের ৩৮০০ ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অপটিকাল ফাইবার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আরো ৭৩৬টি ইউনিয়নকে ফাইবার অপটিক্স নেটওয়ার্কে যুক্ত করার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ছাড়াও, পাহাড়, হাওর, দ্বীপ ও ছিটমহল এলাকাকেও ফাইবার অপটিক্স নেটওয়ার্কে আনার চেষ্টা চলছে। ৪০টি দ্বীপ এলাকা স্যাটেলাইটের আওতায় ডিজিটাল সংযুক্তি পেতে যাচ্ছে। ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘তথ্য বাতায়ন’ চালু করা হয়েছে যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। সারাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের পাশাপাশি স্মার্টকার্ড প্রদান করা হয়েছে। মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ও ই-পাসপোর্ট চালু করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং ডিজিটাল অপরাধ রোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। ১২ মে ২০১৮ মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে। ২ অক্টোবর ২০১৯ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এটি দিয়ে দেশের সব টিভি চ্যানেল সেবা পেতে শুরু করেছে। লার্নিং আর্নিং, শি পাওয়ার, হাইটেক পার্ক, বিসিসি, এসইআইপি ও এলআইসিটির সহায়তায় প্রশিক্ষণ দিয়ে লাখ লাখ যুবক-যুবতিকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানবসম্পদে পরিণত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলসমূহ গড়ে তুলছে ডিজিটাল যুগের দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ। মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি এখন এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ডিজিটাল শিল্প খাতকে কর সহায়তা ও নগদ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেপাল, আমেরিকা, নাইজেরিয়া ও ফিজিতে ল্যাপটপ রপ্তানি হয়েছে। দেশের মোবাইল ফোনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এখন দেশে উৎপাদিত ফোন দিয়েই মেটানো হচ্ছে। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮ ও জাতীয় টেলিকম নীতিমালা ২০১৮ নবায়ন, মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি গাইডলাইন, সিগনিফিকেন্ট মার্কেট প্লেয়ার গাইডলাইন, কোয়ালিটি অব সার্ভিস গাইডলাইন ইত্যাদি প্রণীত হয়েছে। টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। অবকাঠামো শেয়ারিং নীতিমালার খসড়া প্রণীত হয়েছে। আইএলটিডিএস নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। ২৩ সালকে সামনে রেখে আমাদের এখন ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট, তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ও ৫জির কথা ভাবতে হচ্ছে। (পরের কিস্তির অপেক্ষা করুন)
মোস্তাফা জব্বার: মন্ত্রী ,তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়,বাংলাদেশ ।
Discussion about this post