স্মার্টফোন নির্মাতারা এবার ঝুঁকছে সহজে ভাঁজ করে পকেটে রাখা যায় এমন ফোল্ডেবল হ্যান্ডসেট তৈরির দিকে। এ তালিকায় মার্কিন প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপল ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের মতো ডিভাইস নির্মাতারাও রয়েছে। ইতিমধ্যে বাঁকানো ডিসপ্লের ফোন বাজারে ছেড়েছে নকিয়া। তবে ভাঁজ করার সুবিধাযুক্ত ফোন বাজারে এনে সবার আগে তাক তাক লাগিয়ে দিয়েছে চীনের জেডটিই। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে ভাঁজ করা স্মার্টফোন নিয়ে। চলুন জেনে আসি ভাঁজ করা সুবিধাযুক্ত স্মার্টফোনগুলো সম্পর্কে:
জেডটিই
জেডটিই অ্যাক্সন এম নামের এ একটি স্মার্টফোনের ঘোষণা দিয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ডুয়াল ডিসপ্লে-সংবলিত স্মার্টফোন। জেডটিইর অ্যাক্সন এম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এটিঅ্যান্ডটির সঙ্গে মিলে উন্মোচন করা হয়েছে। ডিভাইসটি আগামী মাস থেকে দেশটিতে সরবরাহ শুরু হবে। একই সময় চীন, ইউরোপ ও জাপানের বাজারে এটির সরবরাহ শুরু হবে। জেডটিইর তথ্যমতে, তাদের নতুন এ ডিভাইস ফোল্ড করে সহজে পকেটে রাখা যাবে। ডিভাইসটি ডুয়াল মোডে থাকা অবস্থায় এর দুই ডিসপ্লেতে দুটি ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করা যাবে। এক্সটেন্ডেড মোডে এর এক ডিসপ্লেতে ই-মেইল দেখা এবং অন্য ডিসপ্লেতে ভিডিও গেম খেলতে পারবেন ব্যবহারকারী। ট্র্যাডিশনাল মোডে সাধারণ সব স্মার্টফোনের মতোই ডিভাইসটি ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া মিরর মোডে দুই ডিসপ্লে পরস্পরের বিপরীত দিকে ফোল্ড করা থাকলে একই কনটেন্ট উভয় ডিসপ্লেতে প্লে করা যাবে।জেডটিই অ্যাক্সন এম ফোল্ডেবল স্মার্টফোনে ৫ দশমিক ২ ইঞ্চির ডুয়াল ফুল এইচডি টিএফটি এলসিডি ডিসপ্লে আছে। ডিসপ্লে সুরক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে করনিং গরিলা গ্লাস ৫। ৪ গিগাবাইট র্যামের এ স্মার্টফোনে স্ন্যাপড্রাগন ৮২১ প্রসেসর আছে। এতে ৬৪ গিগাবাইট অভ্যন্তরীণ তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা রয়েছে। ডিভাইসটিতে ২০ মেগাপিক্সেলের একটি ক্যামেরায় ব্যবহার করা হয়েছে, যা রিয়ার ও ফ্রন্ট ফেসিং ক্যামেরা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। অ্যান্ড্রয়েড ৭.১.২ নুগাট অপারেটিং সিস্টেম চালিত এ স্মার্টফোনে ৩১৮০ মিলিঅ্যাম্পিয়ার আওয়ারের ব্যাটারি আছে। ডিভাইসটি কুইক চার্জ ৩.০ প্রযুক্তি সমর্থন করবে।জেডটিইর দাবি, বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজারে নতুন মাত্রা যোগ করবে অ্যাক্সন এম স্মার্টফোন। ডিভাইসটির বিক্রি বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যাওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে।
অ্যাপল
গুঞ্জন উঠেছে ভাঁজ করা যায় এমন আইফোন তৈরি করবে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। আইফোনের নতুন সংস্করণ হতে পারে ভাঁজ করা ডিসপ্লেযুব্ক। নমনীয় আইফোন, ভাঁজ করা ডিসপ্লেযুক্ত নতুন আইফোন নিয়ে কাজ করছে অ্যাপল। নতুন এ আইফোনটি ২০২০ সাল নাগাদ বাজারে আসবে বলে শোনা যাচ্ছে। ফলে পকেটে আইফোন রাখতে দরকার হবে আরও কম জায়গার।২০১৪ সালের জুনে ‘নমনীয় ডিসপ্লে ডিভাইস’-এর পেটেন্টের জন্য আবেদন করে অ্যাপল। এই পেটেন্টে একটি ফোল্ডেবল ডিজাইনে বানানো টাচস্ক্রিন স্মার্টফোনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কীভাবে স্ক্রিনে থাকা নমনীয় ওএলইডি ডিসপ্লে ভাঁজ হতে পারবে সেই পদ্ধতি বলা হয়েছে। এমনকি ফোনটিকে আরও অন্যভাবে ভাঁজ করতে বাড়তি কব্জা লাগানোর কথা রয়েছে, এর মানে হচ্ছে দুই ভাগে ভাঁজ করার পর হয়তো তৃতীয় আরেকটি ভাঁজ করা যাবে আইফোন।সংবাদমাধ্যম দ্য বেল এক প্রতিবেদনে জানায়, ভাঁজ করা ডিসপ্লে ডেভেলপ করার মতো প্রযুক্তি রয়েছে দক্ষিণ কোরীয় প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলজির। তাই এলজির সাথে যৌথভাবে কাজ করছে অ্যাপল।প্রতিবেদনে বলা হয়, এলজির ভাঁজ করা ওএলইডি ডিসপ্লে প্ল্যান্টে বিনিয়োগ করছে অ্যাপল। আরএফপিসিবি নামে খ্যাত নমনীয় প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড ডেভেলপ করার জন্য এরই মধ্যে টিম গঠন করেছে এলজির পার্টস ইউনিট ‘এলজি ইনোটেক’।
স্যামসাং
সম্প্রতি আইফোন টেনের ঘোষণা দিয়ে প্রযুক্তি বিশ্বকে চমক দিয়েছে অ্যাপল। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের শীর্ষ স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং বিশেষ চমক দেয়ার কথা বলেছে। স্যামসাংয়ের মোবাইল ব্যবসা বিভাগের প্রধান ডংজিন কোহ বলেছেন, গ্যালাক্সি নোট সিরিজে চমক দেবে প্রতিষ্ঠানটি। গ্যালাক্সি নোট ৯ হবে বিশ্বের প্রথম ভাঁজ করার সুবিধাযুক্ত স্মার্টফোন। স্যামসাং আশা করছে, আগামী বছর ফ্ল্যাগশিপ গ্যালাক্সি নোট লাইনে নমনীয় স্মার্টফোন আনা সম্ভব হবে। এ প্রযুক্তির স্মার্টফোন বাজারে ছাড়তে এখনো বেশ কিছু বাধা পেরোতে হবে। এসব সমস্যার সমাধান না হলে অবশ্য ভাঁজ করার সুবিধাযুক্ত স্মার্টফোন বাজারে আসা পেছাতে পারে। এর আগে ২০১৩ সালে ‘ইয়োম’ নামে নমনীয় ডিসপ্লের প্রটোটাইপ দেখিয়েছিল স্যামসাং। চার বছর ধরে ভাঁজ করার সুবিধাযুক্ত স্মার্টফোন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গুঞ্জন উঠেছিল স্যামসাং গ্যালাক্সি এক্স নামের নমনীয় স্মার্টফোন বাজারে ছাড়বে। সাত ইঞ্চি মাপের ওএলইডি ডিসপ্লের ওই ডিভাইসটি ভাঁজ করে পকেটে রাখা যাবে। এ সুবিধা ২০১৮ সালে বাজারে আসা নোট ৯এ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হুয়াওয়ে
সম্প্রতি মেট ১০, মেট ১০ প্রো এবং মেট ১০ পোর্শে ডিজাইনের স্মার্টফোন উন্মুক্ত করার সময় চীনের স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েই ফোল্ডেবল স্মার্টফোন তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কনজ্যুমার বিজনেস গ্রুপের সিইও রিচার্ড ইউ জানান, হুয়াওয়েই ইতিমধ্যেই ফোনটির প্রোটটোটাইপ নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আর আগামী বছর যখন স্যামসাং তার ফোল্ডেবল স্মার্টফোন গ্যালাক্সি এক্স বাজারে ছাড়বে তার কাছাকাছি সময়েই হুয়াওয়েইও তাদের ফোল্ডেবল স্মার্টফোন নিয়ে আসবে।হুয়াওয়েই এজন্য আরো নমনীয় স্ক্রিন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে। এ ছাড়া বর্তমানের চেয়ে আরো উন্নত মেকানিক্যাল ডিজাইনও তৈরির চেষ্টা করছে।
মাইক্রোসফট
উইন্ডোজ ফোনকে আকস্মিকভাবে বিদায় বলে দিয়েছে মাইক্রোসফট। তবে পুরোপুরি স্মার্টফোনের বাজার থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেনি। মাইক্রোসফটের কর্মকর্তারা বরং নতুন চমক হিসেবে নতুন ধরনের মাইক্রোসফট ফোনের কথা বলে আসছেন। মাইক্রোসফট নতুন ধরনের ফোনের জন্য পেটেন্ট করাচ্ছে। সেই পেটেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ভাঁজ করা যায় এবং তিনটি মোডে চালানো যায়, এমন স্মার্টফোন তৈরির পরিকল্পনা করছে মাইক্রোসফট।মাইক্রোসফটের নতুন ফোনটিতে ভাঁজ করা যায়, এমন স্ক্রিন যেমন থাকবে, তেমনি এটি ৩৬০ ডিগ্রি মোডে ঘোরানো যাবে। অর্থাৎ, চাইলে ফোনটিকে ট্যাবলেট কম্পিউটার আকারেও ব্যবহার করা যাবে। এটিকে মাইক্রোসফটের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্মার্টফোন বলা হচ্ছে। মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সত্য নাদেলা বলেছেন, মোবাইল হার্ডওয়্যার বাজারে আবার নতুন করে ঢুকতে যাচ্ছে মাইক্রোসফট। এবার স্মার্টফোনের ধারণাই বদলে দেবে মাইক্রোসফট। প্রচলিত কোনো স্মার্টফোনের মতো হবে না মাইক্রোসফটের ফোন। অর্থাৎ স্মার্টফোনের দুনিয়ায় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন দেখাতে যাচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।মাইক্রোসফটের হলোলেন্স বিভাগের প্রধান অ্যালেক্স কিপম্যান বলেছেন, মোবাইল ফোনের ভবিষ্যতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের রিয়্যালিটি প্রযুক্তি যুক্ত থাকবে। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের দুনিয়ায় মাইক্রোসফটকে সফল হতে হলে সাহসী ও উদ্ভাবনী হতে হবে। মাইক্রোসফটের স্মার্টফোনটি হবে টু-ইন-ওয়ান। গুঞ্জন উঠেছে, মাইক্রোসফট একটি ডিভাইসে নানা রকম সুবিধা দেওয়ার পণ্য তৈরিতে আগ্রহী। পেটেন্ট অনুযায়ী, মাইক্রোসফটের স্মার্টফোনে থাকছে জিরো ডিগ্রি, ১৮০ ডিগ্রি ও ৩৬০ ডিগ্রি মোড। জিরো ডিগ্রির অর্থ, এটি প্রচলিত স্মার্টফোনের মতো কাজ করবে। ১৮০ ডিগ্রি বাঁকা করে এটি ট্যাব হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া এটি ভাঁজ করে পকেটে রাখা যাবে।
নকিয়া
নকিয়া ব্র্যান্ডের নতুন স্মার্টফোন এনে সাড়া ফেলেছে ফিনল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান এইচএমডি গ্লোবাল। অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার না করে যে বাজার হারিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি, তা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি উদ্ভাবনী ফিচারসহ নকিয়া ৭ নামের নতুন স্মার্টফোন বাজারে ছেড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নকিয়ার ফিরে আসার চমক এখানেই শেষ নয়। আরো বড় চমক নিয়ে বাজারে হইচই ফেলে দিতে চাইছে ফিনল্যান্ডের এই প্রতিষ্ঠানটি। ভাঁজ করা যায় এমন স্মার্টফোন বাজারে আনতে যাচ্ছে নকিয়া। এজন্য ২০১৩ সালে করা পেটেন্ট আবেদন অনুমোদন পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অফিস সম্প্রতি এই অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে ব্যবহার করা স্মার্টফোনগুলোর আকারের এই ফোনটি দেখতে হবে অনেকটা পকেট আয়নার মত।নতুন এই সেটের বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানায়নি নকিয়া। নতুন স্মার্টফোনটি তৈরি করা শুরু হয়েছে কীনা, কিংবা কবে নাগাদ সেটি বাজারে আসবে সেসব বিষয়ে কিছুই জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি।
লেনোভো
একই ডিভাইসে ট্যাব ও স্মার্টফোনের ধারণা দেখিয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান লেনোভো। ‘লেনোভো ফোলিও’ ডিভাইসটি ফোল্ড বা ভাঁজ করে সেটি যে কোনো মোবাইল ফোনের মতই পকেটে রাখা যাবে। আবার ভাঁজ খুলে দিলেই হয়ে যাবে ট্যাব। নতুন ধারণার এই গ্যাজেটটিতে থাকবে ৭.৮ ইঞ্চি স্ক্রিন ডিসপ্লে, কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন ৮০০ প্রসেসর। এতে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম থাকবে। বিশেষ উপায় ভাঁজ করলেই ট্যাবটি ৫.৫ ইঞ্চির মোবাইল ফোনের আকার নেবে। সেই সঙ্গে অদল-বদল হবে ট্যাবের সফটওয়্যার সিস্টেমেও। ট্যাবের জন্য বিশেষ ক্যামেরা বদলে হবে মোবাইল ফোনের উপযুক্ত ব্যাকআপ ক্যামেরায়।
Discussion about this post