অনলাইন ডেস্ক
পৃথিবীতে সাত হাজারের বেশি ভাষার প্রচলন। এগারোটি ভাষা বেশি প্রচলিত। এসব ভাষা পরস্পর যেমন নানা বৈচিত্র্য ধারণ করে, অনুরূপ এগুলোর মধ্যে অসংখ্য মিলও খুঁজে পাওয়া যায়।
সক্রেটিসের সময়কাল থেকেই ভাষার উৎপত্তি সংক্রান্ত আলোচনা ছিল ভাষাতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকদের প্রিয় আলাপ। প্লেটোর ‘ক্র্যাটাইলাস’ বইয়ে এমন একটি বিতার্কিক কথোপকথনের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে দার্শনিক সোফিস্ট ক্র্যাটাইলাস দাবী করেন জগতের সব কিছুর নামকরণের পেছনে রয়েছে একজন ‘নামকর্তা’র ভূমিকা। সেই নামকর্তা হতে পারে স্বয়ং ঈশ্বর কিংবা আদিমকালের কোনও পৌরাণিক বীর৷ ক্র্যাটাইলাস মনে করেন নামকর্তা নামকরণ করে প্রতিটা জিনিসের অন্তর্নিহিত প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে।
সক্রেটিস ক্র্যাটাইলাসের দাবীর উপর পাল্টা যুক্তি জারি করেন। তিনি প্রশ্ন তুলেন কীভাবে সেই নামকর্তা সবকিছুর নামকরণ করল যদি তার পূর্বে কোনও ভাষার অস্তিত্বই না থাকে যার মাধ্যমে নামকর্তা কোনও জিনিসের অন্তর্নিহিত প্রকৃতিকে ভাষার মাধ্যমে চিহ্নিত করতে পারে? সক্রেটিসের এই প্রশ্নের মুখে খারিজ হয়ে যায় ক্র্যাটাইলাসের তত্ত্ব।
এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকপর্বের যুগে ভাষার উৎপত্তি সংক্রান্ত আলোচনা আবার নতুন করে শুরু হয়। তারও কয়েক দশক পরে জার্মান মনোবিজ্ঞানী উইলহেম উন্ড লক্ষ্য করেন ভাষার উৎপত্তি নিয়ে যত তত্ত্ব ও প্রস্তাবনা আলোচিত হয়েছে সব কটিই দুটি বিপরীত দর্শন ইঙ্গিত করে: মানব জগতে ভাষার আবির্ভাব ও ব্যবহারের সক্ষমতা কোনও ‘ঐশ্বরিক দান’ নাকি মানব জাতির বিবর্তনের সাথে সাথে এটি মনুষ্য জাতিরই উদ্ভাবন?
ধরুন, আপনি চা পান করছেন কিন্তু চা-পানে আপনার কোন চাওয়া নেই, তাহলে চিনি নিতান্তই নিরীহ খাদ্যে পরিণত হবে, ঠোঁটে তা পানসে লাগবে। চীনারা চা-কে চা (茶/Chá) উচ্চারণ করে।
এ চা-ই উর্দু এবং হিন্দিতে ‘চায়ে’ এবং ফার্সিতে ‘চাই’ উচ্চারিত হয়। চা যখন আরব ভূখন্ডে পৌঁছায়, তখন আরবরা এর ‘চ-কে ‘শ’-তে পরিবর্তন করে ‘শাই’ বলতে লাগল। ঠিক ইংরেজি শব্দ চিকেনকে শিকেন বলার মতো।
চীনা ভাষায়ই চার আরেক নাম ‘তে’। তে ইংরেজিতে এসে ‘টি’ (Tee) রূপ নিল। ফরাসি ভাষায় ‘দি’ (thé) এবং জার্মান ভাষায় ‘টি’ (Tee)।
এক সময় মানুষ চা পান করত পেয়ালায়। এখন পেয়ালার স্থান দখল করেছে কাপ এবং মগ। এক্ষেত্রে পেয়ালার ব্যবহারই যে সঙ্গত ছিল তা বুঝতে পারি পেয়ালার সম্পর্ক ‘পিনা-পিলানা’ (পান করা-পান করানোর সঙ্গে-এই কথা থেকে।)
সংস্কৃত ভাষায় পেয়ালাকে বলা হয় কাসা। উর্দু এবং হিন্দিতেও, তবে এ দুই ভাষায় শব্দটির ব্যবহার খুবই কম। ফার্সিতে এর উচ্চারণ ‘কাসাহ’। ফার্সি ভাষীরা কাসাহ শব্দের বহুবিধ ব্যবহার করে থাকে। আসমানকে তারা বলে ‘কাসাহ পুশত’ বা উল্টো পেয়ালা।
ফার্সির কাসাহ আরবে গিয়ে ‘কা’ছ’ রূপ ধারণ করল। এখান থেকেই আরবি ভাষায় বহুল ব্যবহৃত যুক্তশব্দ ‘কা’ছুল কিরাম’-এর উৎপত্তি। যার আক্ষরিক অর্থ, বরকতপূর্ণ কাপ।
আরবিতে কাপের জন্য ‘কুব’ শব্দের ব্যবহারও খুব প্রচলিত। কুবের প্রতি ভাল করে ধ্যান দিলে ইংরেজি শব্দ ‘কাপ’-কে অত্যন্ত স্বচ্ছ দেখায়। ইংরেজিতে যেমন বলে, ওয়ার্ল্ড কাপ। আরবিতে এটিকেই ‘কা’ছুল আলাম’ বা বিশ্বকাপ বলা হয়। উর্দুতেও আরবি শব্দ ‘আলাম’-এর সচরাচর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
আলামের প্রতিশব্দ হিসেবে আরবিতে ‘দুনিয়া’ শব্দটি বেশ প্রচলিত। এটি ‘দানি’ মূলধাতু থেকে উদগত। যার অর্থ, তুচ্ছ, নিচু ইত্যাদি। এ কারণেই ইতরকে ‘দানি’ সম্মোধন করার প্রবণতা দেখা যায়।
দানির কাছাকাছি শব্দ ‘আদনা’র ব্যবহার উর্দু, হিন্দিতে প্রচলিত। যার অর্থ, সামান্য। যদি আদনা শব্দের ওপর একটু খেয়াল করি, তাহলে বোধগম্য হবে পরজগতের অসংখ্য নেয়ামত ও চিরন্তন সুখময় জীবনের তুলনায় ইহজগতকে কেন দুনিয়া বলা হয়।
বাংলা, উর্দু, হিন্দি শব্দ ‘খেয়াল’-এর সম্পর্ক আরবি খাইলের সঙ্গে। এর অর্থ ঘোড়া। খাইল ঘোড়ার গুণবাচক নাম। বস্তুত ঘোড়ার এক বিশেষ স্বভাবকে ‘খায়ালাহ’ বলে। এজন্য খায়ালার স্বভাবজাত এ প্রাণীকে ঘোড়া নামকরণ করা হয়।
আর খাইল (ঘোড়া) দেখাশোনার কাজকে বলা হয় খেয়াল। খেয়ালের কাছাকাছি শব্দ ‘খালা’, এর প্রতি গভীর চিন্তা করুন, মায়ের পর তিনিই সন্তানদের বেশি খেয়াল রাখেন।
এবার মা শব্দের ওপর দৃষ্টি দিন। আশ্চর্যের বিষয়-পৃথিবীর নানা প্রান্তে ‘মা’ বোঝাতে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়, তার বেশিরভাগ শব্দের মূল উচ্চারণে ‘ম’ পাওয়া যায়।
যেমন, সংস্কৃত ভাষায় ‘মাতার’, উর্দু, হিন্দিতে ‘মাঁ, আম্মাঁ, উম্মি’, পশতুতে ‘মুর’, আরবিতে ‘উম্ম, উম্মি’, ফার্সিতে ‘মাদার’, ল্যাটিনে ‘ম্যাটার’ (mater), গ্রীকে ‘মেতিরা’ (μητέρα), ইংরেজিতে ‘মাদার, মম, মাম্মি’, ফরাসিতে ‘মেখ’ (mère), জার্মানিতে ‘মোটার’ (Mutter) এবং চাইনিজ ভাষায় ‘মুচান’ উল্লেখযোগ্য।
বিস্ময় এখানেই শেষ নয়; চাইনিজের মুচানের মধ্যে আরবি শব্দ ‘মুহসিন’ খুঁজে পাওয়া যায়, এর অর্থ উপকারী ও কল্যাণকামী। সন্তানের প্রতি নিস্বার্থ ভালবাসার ক্ষেত্রে মা ছাড়া বড় মুহসিন আর কে হতে পারে?
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় একটি ভাষা চিত্রালি বা কাহওয়ার। এ ভাষায় মায়ের প্রতিশব্দ ‘নান’। এর উপর ভিত্তি করে ‘নানা-নানি’ শব্দ দুটি নিয়ে চিন্তা করলেই বোধগম্য হয় যে, ‘নান’ থেকেই শব্দ দুটির উৎপত্তি।
মায়ের প্রতিশব্দ ‘নান’ যদিও অন্য কোনও ভাষায় ব্যবহার দেখা যায় না, তবে ‘নানা-নানি’ ইঙ্গিত দেয় যে, কোন সময়ে হয়তো অনেক ভাষায় ‘নান’ প্রচলিত ছিল। সংস্কৃত ভাষায়ও মায়ের জন্য নানের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এবার প্রশ্ন জাগতে পারে-‘নান’ থেকে ‘নানা-নানি’র উৎপত্তি হলে ‘দাদা-দাদি’র উৎসস্থল হবে ‘দাদ’।
এরূপ প্রশ্ন যথার্থ। কেননা, সংস্কৃতে বাবার প্রতিশব্দ ‘তাত’। যা মূলত ‘দাদ’-এর আসল। এই ‘দাদ’ থেকেই ‘দাদা-দাদি’।
ফার্সিতে পিতাকে বলা হয় ‘পাদার’। এটিই সামান্য পরিবর্তন হয়ে ইংরেজিতে ‘ফাদার’ এবং স্প্যানিশ ভাষায় ‘পাদরি’ উচ্চারিত হয়। আবার ফার্সিতে বাবার আরেক প্রতিশব্দ ‘বাব’। এটি থেকেই ‘বাবা’র উৎপত্তি, যেটা ইংরেজিতে ‘পাপা’য় রূপান্তরিত হয়। অপরদিকে ফার্সির ‘বাব’ উর্দু ও হিন্দিতে উচ্চারিত হয় ‘বাপ’।
একই সঙ্গে এ দু’ভাষায় পিতার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘বাপু’ ও ‘বাবু’রও প্রচলন দেখা যায়। আরবিতে পিতাকে ডাকা হয় ‘আবু’ ও ‘আবি’ শব্দে। এটাই আবার উর্দুতে ‘আব্বু ও আব্বা’য় রূপান্তরিত হয়।
Discussion about this post