বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজ্ঞানীর সংখ্যা একদমই কম। তবুও সত্যেন বোস, জগদীশচন্দ্র বসু, মাকসুদুল আলমের মত নামকরা বিজ্ঞানী জন্মেছেন এখানে। জন্মেছেন জামাল নজরুল ইসলামের মত মহান বিজ্ঞানী ও ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে একজন পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যাোতির্বিজ্ঞানী, ও বিশ্বতত্ত্ববিদ। বাংলাদেশের জন্য গর্ব উদ্রেককারী এই ক্ষণজন্মা আসন পেতে আছেন অনেকের হৃদয়েই। তার সম্পর্কে জানা উচিৎ প্রত্যেক বাংলাদেশির! তাহলে চলুন জেনে নিই অধ্যাপক জামাল নজরুলের জীবনী।
জন্ম ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
জামাল নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ঝিনাইদহে। দিনটির কোনো বিশেষত্ব তখন ছিলো না। তখনও বিশ্ববাসী কিংবা বাংলাদেশ জানতো না, এখানে একজন মহান ব্যক্তি জন্ম নিয়েছেন। তার বাবা চাকুরী করতেন কলকাতাতে। তখনও ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়নি।
জামাল নজরুলের ছেলেবেলা কাটে কলকাতাতেই। ৪র্থ শ্রেণী সম্পন্ন করে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন ও পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তবে এখানে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি চমৎকার কৃতিত্ব দেখান। ফলে “ডাবল প্রমোশন” পেয়ে সরাসরি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়ালেখা করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে ও’লেভেল এবং এ’লেভেল পাস করেন।
এ’লেভেলের পাট চুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স শেষ করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে তিনি কেমব্রিজে পড়তে যান। এখান থেকে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৯ সালে। ১৯৬০ সালে সম্পন্ন করেন মাস্টার্স। এখান থেকেই গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। আবার কেম্ব্রিজ থেকেই “ডক্টর অব সায়েন্স” ডিগ্রি অর্জন করেন।
ব্যক্তিত্ব
সময়টা ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তখন তিনি দেশে ছিলেন না। কিন্তু তাই বলে কি দেশের প্রতি তাঁর ভালবাসা কমেছে? না, একটুও কমেনি। তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখলেন যুদ্ধের বিস্তারিত জানিয়ে। যুদ্ধ বন্ধে সহায়তা করতে অনুরোধ করলেন।
চট্টগ্রামে পাহাড় ধ্বসে মানুষ মারা গিয়েছিলো। জামাল নজরুল ইসলাম বসে থাকেননি। তিনি তাঁর সাধ্যমত সাহায্য করেছিলেন হতাহতের পরিবারকে। ২০০১ সালে গুজব রটে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে তাড়াতাড়িই। কারণ হিসেবে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো জানায়, সৌরজগতের গ্রহগুলো এক সরলরেখা বরাবর চলে আসবে তাই! সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন, আপাতত পৃথিবী ধ্বংসের কোনো লক্ষণ নেই। আর গ্রহগুলোর সরলরেখার সাথে পৃথিবী ধ্বংসের কোনো সম্পর্ক নেই।
ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন আজব প্রকৃতির! আশ্চর্যজনকভাবে, তিনি ক্যালকুলেটরের প্রতি অনীহা পোষণ করতেন। গণিতের হিসেব নিজের মাথা খাটিয়ে করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তাঁর সম্বন্ধে ছাত্র জাহিদ রোকন বলেছেন,
বিজ্ঞানী হলেও তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় ছিলেন অগ্রপথিক। ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’ ছাড়াও ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’ নামে তাঁর আরেকটি বই আছে। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখেছেন। কবিতা পছন্দ করতেন। প্রায়ই তাঁর বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতার উদ্ধৃতি থাকতো। আমার প্রথম কবিতার বই বের হওয়ার পর যখন দিতে গেলাম খুব আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে বললেন, আমি পড়বো। একই সাথে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের উপর আমার দুটো লেখা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বইয়ের সমুদ্রে হয়তো এর খোঁজই থাকবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আবার যখন ‘আরসিএমপিএস’-এ গেলাম, শরীফ ভাই বললো, তোমার বই আর লেখা পড়লাম। স্যার শুধু শরীফ ভাই নয়, শিক্ষকদেরও কাউকে কাউকে দিয়ে লেখাগুলো পড়িয়েছেন। খুব কমিউনিকেট করতে পারতেন। সেদিন ফিজিক্সের এক শিক্ষক ছিলো তাঁর চেম্বারে। আমরা যাবার পরই আমার লেখা নিয়ে কথা শুরু করলেন স্যার। ঐ শিক্ষককে বলছিলেন, ‘ওর লেখা তো সেদিন তোমাকেও পড়তে দিলাম, তাই না?’ ‘জি স্যার’ প্রত্যুত্তরের পর সেই শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কোন ইয়ারে পড়? …আগে পড়াশুনাটা ভালো মতো শেষ কর। তারপর অন্য কিছু করা যাবে।’ আর জামাল স্যার বারবার শুভকামনা জানিয়ে লেখা চালিয়ে যাবার তাগিদ দিচ্ছিলেন। এই হলো শিক্ষকে-শিক্ষকে পার্থক্য। স্যার বেশ ভালো গান গাইতেন। নিজেই বাজাতেন। আমাদের একবার পিয়ানো বাজিয়ে শুনালেন। সার্সন রোডের বাসায় মাঝে মাঝে আসর জমতো। ডকুমেন্টারি দেখানো হতো। এসময় স্যারের সঙ্গী অনেক বিখ্যাত মানুষ সম্পর্কে জানা যেতো।
বিজ্ঞানীদের সাহচর্য
জামাল নজরুল ইসলাম তার ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে বেশ কিছু বিজ্ঞানীর সাথে দিন যাপনের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। বর্তমান সময়ের আলোচিত বিজ্ঞানী “স্টিফেন হকিং”-এর বন্ধু ও রুমমেট ছিলেন আমাদের দেশের এই কৃতি সন্তান। ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা ছিলেন ওনার সহপাঠী। তাঁর বন্ধু ছিলেন নোবেল জয়ী ব্রায়েন জোসেফসন, আব্দুস সালাম, রিচার্ড ফাইনম্যানের মত বিজ্ঞানীরা। রিচার্ড ফাইনম্যানের সাথে তাঁর ছিলো খুব ভালো সম্পর্ক। তাঁকে একটা মেক্সিকান নকশী কাঁথা উপহার দিয়েছিলেন ফাইনম্যান।
কর্মজীবন
জামাল নজরুল ইসলামের কর্মজীবন খুবই চমকপ্রদ!
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে পোস্ট ডক্টোরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেম্ব্রিজের ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমিতে কাজ করেন। মাঝে ১৯৬৮-তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্ট্যাডিতে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭১ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭২-এ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন গবেষণা সহযোগী হিসেবে। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় আবারো তিনি ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্ট্যাডিতে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেও পরে রিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৮৪ পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন। এসময় তিনি ৩য় বারের মত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্ট্যাডিতে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
বিজ্ঞানচর্চায় অবদান
১৯৭৭ সালে করা ডঃ জামালের একটি গবেষণার (Possible Ultimate Fate of the Universe) ড্রাফ্ট থেকে বড় বড় বিজ্ঞানীরা উৎসাহিত হয়েছিলেন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে।
এ বিষয়ে ডঃ জামালের অবদানের কথা স্বীকার করে বিখ্যাত পদার্থবিদ এবং গণিতজ্ঞ ফ্রিম্যান ডাইসন বলেন,
We are particularly indebted to Jamal Islam, a physicist colleague now living in Bangladesh. For an early draft of his 1977 paper which started us thinking about the remote future.
বিজ্ঞানের জগতে ডঃ জামালের অবদান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী ডঃ আব্দুস সালামের কথায়ই বোঝা যায়। তিনি বলেছিলেন,
এশিয়ার মধ্যে আমার পরে যদি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নোবেল পুরস্কার পায়, তবে সে হবে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম।
মাতৃভূমির টানে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৮৪ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে গড়ে তোলেন রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল এন্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলা আধুনিক গবেষণাগারটিই সম্ভবত তাঁর জীবনের বড় অবদান। “কেন ফিরে এসেছেন?” এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন,
আমার বাড়ি চিটাগং। এজন্য এখানে জয়েন করি। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমি এখান থেকে নিতে আসিনি, দিতে এসেছি।
তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি, রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য ছিলেন তিনি।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ডঃ জামাল অনেক উৎসাহ জুগিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন,
“অনেকের ধারণা, ভালো ইংরেজি না জানলে বিজ্ঞানচর্চা করা যাবে না। এটা ভুল ধারণা। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হতে পারে, উচ্চতর গবেষণা হতে পারে। বাংলায় বিজ্ঞানের অনেক ভালো বই আছে। আমি নিজেও অনেক প্রবন্ধ বাংলায় লিখেছি। অনেকেই বাংলাতে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখছেন। তাঁদের সমস্যা হয় বলে আমার মনে হয় না। সুতরাং বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাটা গুরুত্বপূর্ণ।”
রচিত গ্রন্থসমূহ
১) দ্যা আলটিমেট ফেইট অব দ্যা ইউনিভার্স (১৯৮৪)
২) ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪)
৩) রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪)
৪) অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি(১৯৯২)
৫) স্কাই অ্যান টেলিস্কোপ
৬) দ্যা ফার ফিউচার অব দ্যা ইউনিভার্স (স্প্যনিশ ভাষায় অনূদিত)
৭) কৃষ্ণবিবর
৮) মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ
৯) শিল্পসাহিত্য ও সমাজ
পুরষ্কার ও সম্মাননা
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে জামাল নজরুল ইসলামকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আব্দুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেওয়া হয়। তিনি ২০০০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ ও জেবুন্নেছা পদক পান। ২০০১ সালে লাভ করেন একুশে পদক। ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক পান।
মৃত্যু
ফুসফুস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অধ্যাপক ডঃ জামাল মৃত্যুবরণ করেন। তারিখটা ছিলো ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ। আপনার সন্তানকে বাংলাদেশিদের বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারে বলতে চান? তাহলে জামাল স্যারের কথা অবশ্যই বলবেন।
Discussion about this post