বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ আমাদের বিজ্ঞানীরা বসে নেই। তারা নিত্যনতুন চিন্তা ভাবনা করে চলেছেন। তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয় যা আপনাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে। প্রত্যেক জীবেরই প্রজনন হয়। আর প্রাণীদের ক্ষেত্রে সেই প্রজনন ঘটে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মাধ্যমে। যৌন ক্রিয়ার সময় শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিলিত হয় এবং নিষেকের পর ভ্রূণ গঠিত হয়। সেই ভ্রূণ পরিণত হয়ে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে পরিণত হয়। এটাই প্রাণীর স্বাভাবিক প্রজননের সরল একটি বর্ণনা। কিন্তু বিজ্ঞান তো এতটুকুতেই থেমে নেই। তারা মানবদেহের প্রজনন ক্রিয়া বোঝার জন্য অনরবত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার ফলস্বরূপ ১৯৯৭ সালে আমরা পেয়েছি ‘ডলি’কে। ‘ডলি’ ভেড়ার কথা আমরা সবাই জানি। ‘ডলি’র মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা প্রথম কোন স্তন্যপায়ীকে ক্লোন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর আগে ব্যাঙের ক্লোন করা হয়েছিলো। ‘ডলি’র ক্লোন করা ছিলো প্রজনন বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বিশাল পদক্ষেপ। তারপর আমরা দেখেছি টেস্টটিউব শিশু। যেখানে নারী ও পুরুষের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে দেহের বাইরে মিলিত করা হয়। কিন্তু যদি বলা হয় ত্বকের কোষ থেকে শুক্রাণু কিংবা ডিম্বাণু তৈরি সম্ভব তাহলে হতবাক হতেই হয়।
বিজ্ঞানী হাইয়াশি ইঁদুরের ত্বক কোষ থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তা থেকে ইঁদুরের সন্তানের জন্ম হয়েছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষের ক্ষেত্রেও এটি সম্ভব হবে। এমন অনেক দম্পতি আছেন যাদের সন্তান হয় না। অনেক সময় দেখা যায় পুরুষের শুক্রাণুতে সমস্যা রয়েছে। আবার অনেক সময় মহিলাদের ডিম্বাণুতেও সমস্যা দেখা দেয়। আবার বয়স হয়ে গেলে নারীরা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়ে যান কারণ তখন তাদের ডিম্বাণু তৈরি হয় না। কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে ল্যাবে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি করা সম্ভব। তাই তখন যেকোনো নারী অথবা পুরুষ শুধু মাত্র একটু রক্ত দিলেই তা থেকেই তৈরি হতে পারে তাদের সন্তান। এমনকি যারা সমলিঙ্গ বিবাহিত তারাও তাদের জৈবিক সন্তান পেতে পারেন। তবে এখন পর্যন্ত মানুষের উপর এটি প্রয়োগ করা হয় নি।
হাইয়াশি এই পদ্ধতিটির মূল পেয়েছিলেন ইয়ামানাকার গবেষণা থেকে। জাপানের কয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ামানাকা গবেষণা করে বের করেছিলেন কীভাবে যেকোনো কোষকে স্টেম কোষে রূপান্তরিত করা যায়। এ আবিস্কারের জন্য তিনি ২০১২ সালে নোবেল পুরস্কার পান। প্রথমে হাইয়াশি একটি পূর্ণ বয়স্ক ইঁদুরের লেজ থেকে কোষ নেন। সেই কোষকে তারপর রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে মেশান। সেই রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে থাকে চার ধরণের জিন যা ঐ কোষকে স্টেম কোষে পরিণত করে যা ডিম্বাণু তৈরিতে সক্ষম। এখন এই ডিম্বাণুকে পরিণত করার জন্য সঠিক পরিবেশ দরকার। বিজ্ঞানীরা এজন্য ডিম্বাণু তৈরিতে প্রস্তুত সেই স্টেম কোষকে জীবিত ইঁদুরের জরায়ুতে প্রবেশ করান। কিন্তু তাতেও যেন ডিম্বাণুটি পুরোপুরি তৈরি করতে জরায়ুর উপর নির্ভর করতে হচ্ছিলো। তাই তারা ইঁদুরেরে ডিম্বাশয়ের কোষ নিয়ে তা সেই স্টেম কোষটির সাথে রাখলেন যাতে স্টেম কোষটি মনে করে সে জরায়ুতে আছে। পাঁচ সপ্তাহে ডিম্বাণুটি পরিণত হলে এটিকে একটি স্বাভাবিক শুক্রাণুর সাথে তারা মিলিত করেন। উৎপন্ন ভ্রূণ একটি ইঁদুরের দেহে প্রবেশ করান। এই গবেষণায় শেষ পর্যন্ত আটটি ইঁদুর টিকে থাকে। পরবর্তীতে এই ইঁদুরগুলো নিজেরা বংশবৃদ্ধি করে।
আমেরিকার ১০% নারী-পুরুষ সন্তান জন্মদানে অক্ষম। অনেকে তখন আইভিএফ তথা ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের শরণাপন্ন হন। আইভিএফকে আমরা সবাই টেস্ট টিউব বেবি পদ্ধতি নামে চিনি। এই পদ্ধতিটি অনেক ব্যয় বহুল। এতে প্রায় ২০০০০ হাজার ডলার খরচ হতে পারে। তবে শতকরা ৬৫ ভাগ সময় এটি ব্যর্থ হয়। আবার স্বামী-স্ত্রীর যেকোনো একজনের জনন কোষ সুস্থ না থাকলে তখন শুক্রাণু কিংবা ডিম্বাণু দাতা খুঁজতে হয়। যা কি না সবাই গ্রহণ করতে চান না। কারণ এতে মূল্যবোধের ব্যাপার চলে আসে। আবার এতে যেকোনো একজন, পুরুষ অথবা নারী, সন্তানটির জৈবিক অভিভাবক হওয়া থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু আইভিজি-তে বাবা মা উভয়ই সন্তানের জৈবিক অভিভাবক হতে পারেন। এই পদ্ধতিতে নারীদের কৃত্রিমভাবে হরমোন দেয়া হয় যাতে করে সে বেশী পরিমাণে ডিম্বাণু তৈরি করে। এখন এই অতিরিক্ত হরমোনে নারী দেহে কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় কি না তা এখনও জানা যায় নি।
ইঁদুরের ক্ষেত্রে এটি করা সহজ হলেও মানুষের ক্ষেত্রে এত সহজ নয়। কারণ ইঁদুরের ডিম্বাণু পরিণত হতে সময় লাগে পাঁচ দিন। আর মানুষের ডিম্বাণু পরিণত হতে সময় লাগে ৩০ দিন। এতদিন ধরে ডিম্বাণুটিকে ঠিক রাখা একটা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে প্রাইমেট নিয়ে গবেষণা করা শুরু করে দিয়েছেন। মারমোসেট বানর নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। এই বানরের গর্ভ ধারণে ১৪০ দিন সময় লাগে। তবে এখন বানরের পরিবর্তে শুকরও ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ শুকুরের ভ্রূণের গঠনের ধাপ মানুষের সাথে মিলে। আর শুকুর বানরের চেয়ে সহজলভ্য ও সস্তা।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ডিম্বাণুকে পরিণত করার জন্য ডিম্বাশয়ের কোষ লাগে। কিন্তু হায়াসী যেই কোষটি ডিম্বাণু পরিণত করার সিগন্যাল দেয় সেটিকে শনাক্ত করতে চাচ্ছেন। স্টেম কোষ থেকে সেই কোষটি তৈরি করার পদ্ধতিও তিনি আবিষ্কার করতে চান। যাতে করে ডিম্বাণু তৈরি থেকে পরিণত করার পুরো প্রক্রিয়াটি ল্যাবে সম্পন্ন করা যায়। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন ডিম্বাণুগুলোকে ল্যাবে পরিণত করলে কিছু সমস্যা থেকে যায়। কারণ এতে হয়তো দুর্বল শুক্রাণু তৈরি হতে পারে। কিন্তু শুক্রাণু তৈরিতে সক্ষম স্টেম সেলকে সরাসরি শুক্রাশয়ে স্থানান্তর করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কারণ আমাদের দেহ যে শুক্রাণুগুলো সুস্থ শুধু সেগুলোকেই বাছাই করে। আর ল্যাবে অযোগ্য শুক্রাণু দ্বারা নিষেক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ওনারা কৃত্রিমভাবে তৈরি শুক্রাণু শুক্রাশয়ে স্থাপনের পক্ষপাতী।
অনেকে এই কৃত্রিম ডিম্বাণু ও শুক্রাণু তৈরিতে সম্মতি দেন না। কারণ এতে বিকলাঙ্গ ও দুর্বল সন্তান জন্ম নিতে পারে। শিশু হয়তো পরবর্তীতে জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর এতে মূল্যবোধ জনিত কিছু সমস্যাও থেকে যায়। কারণ এতে যেকোনো কারও কোষ নিয়ে তার সম্মতি ছাড়াই সন্তান তৈরি করা যায়। এতে সন্তানের ভরণ-পোষণের দ্বায়ভার নিয়ে সমস্যা দেখা দিবে। আবার এভাবে অতি সহজে মানুষ তৈরি মানুষের জীবনের গুরুত্ব কমিয়ে দিবে। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান কমে যাবে। আরেকটি মজার ব্যাপার হলো এতে একজন মানুষের কোষ থেকেই শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি করে সন্তান তৈরি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ঐ সন্তানের মা ও বাবা একজনই হবে। আমেরিকায় এসব কথা চিন্তা করে ভ্রূণ গবেষণায় টাকার অনুদান কমিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও ওবামা প্রশাসন এটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো এটিকে আবার কমিয়ে দিবে। আবার দেশ ভেদেও গবেষণা নির্ভর করে। যেমন জাপানে ভ্রূণ নিয়ে গবেষণা নিষেধ। কিন্তু ইজারাইলে এ নিয়ে কোন বিধি নিষেধ নেই বরং এতে উৎসাহ দেয়া হয়।
তবে এই গবেষণার ভালো ফলগুলোও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সন্তান জন্মদানে অক্ষম স্বামী-স্ত্রী এই পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান লাভ করতে পারে। আবার এপিজেনেটিক্সে পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নানা রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার জন্যও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই সব পক্ষের সাথে বসে এই গবেষণা নিয়ে গভীর আলাপ আলোচনা করা দরকার। যাতে করে এই গবেষণার সুফল আমরা ভোগ করতে পারি এবং এর খারাপ দিক থেকে আমরা বেঁচে থাকতে পারি।
তথ্য সুত্রঃ
সাইন্টিফিক আমেরিকান
Discussion about this post