পলের কথা মনে পড়ে? ঐযে অক্টোপাসটা, ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপে আগে থেকে ম্যাচের ফলাফল ভবিষ্যদ্বাণী করে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল।পলের সামনে দুই দেশের পতাকাসম্বলিত দুইটা বাক্সে খাবার রাখা হত, ও যে বাক্সের খাবার খেত ধরে নেয়া হত সে দল জিতবে। কিন্তু সমুদ্রে অক্টোপাস তো এমন বাক্সভর্তি খাবার পায় না। তোমরা হয়তো জানো সমুদ্রে শিকারকে কাবু করতে অক্টোপাস তার শুঁড় ব্যবহার করে। আচ্ছা অক্টোপাস কিভাবে বুঝে কোনটা তার শিকার? কেন, চোখে দেখে। কিন্তু, শিকার ধরা বা চলাচলে অক্টোপাসের শুঁড়ের কি কোনই অবদান নেই? আছে। সত্যি বলতে কি, শুধু অক্টোপাস না, প্রানিজগতের সকল প্রানিরই জীবনধারণে স্পর্শানুভূতির (touch or tactile perception) প্রভাব আছে। কোন প্রানির ক্ষেত্রে বেশি, কারো কম।
রিসেপ্টর পরিচিতি: অক্টোপাসের ক্ষেত্রে কিন্তু এই ইন্দ্রিয় বেশ ভালোই প্রভাব ফেলে। অক্টোপাসের আটটি শুঁড়ে (arm) অনেকগুলো চোষক (sucker or suction cup) রয়েছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রায় ১৯২০টি।
এই বৃত্তাকার চোষকগুলোয় থাকে হাজারখানেক সংবেদক বা রিসেপ্টর (receptor)। রিসেপ্টর হল সংবেদী স্নায়ুকোষের (sensory neuron) একটি অংশ যা বিভিন্ন ধরনের সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে। শুঁড় ছাড়াও অক্টোপাসের ত্বক, এমনকি পেশিতেও রিসেপ্টরের খোঁজ পাওয়া যায়। মূলত এই রিসেপ্টরগুলোর সৃষ্টি করা বিভিন্ন ধরনের সংবেদন অক্টোপাসের মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
অক্টোপাসের স্পর্শানুভূতি নিয়ে কথা বলার আগে রিসেপ্টরগুলোর সম্বন্ধে আরও ভালভাবে জানা যাক। আগে যেমন বললাম, রিসেপ্টর হল সেন্সরি স্নায়ুকোষের একটি অংশ যা বিভিন্ন ধরনের অনুভূতিকে তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেত আকারে সেন্সরি স্নায়ুকোষের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে (মস্তিষ্ক ও সুষুম্না কাণ্ড) পাঠায়। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এই সংবেদনের (impulse) বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার সংবেদন মোটর স্নায়ুর মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঙ্গে পাঠায়, যার ফলে প্রানি বুঝতে পারে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে। অক্টোপাসের দেহে সাধারণত দুইধরনের রিসেপ্টরের সন্ধান পাওয়া যায়। মেকানোরিসেপ্টর (mechanoreceptor) ও কেমোরিসেপ্টর (chemoreceptor)। মেকানোরিসেপ্টর বাহ্যিক চাপ এবং কেমোরিসেপ্টর রাসায়নিক বস্তুর উপস্থিতিকে তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেতে রূপান্তরিত করে এবং মস্তিষ্কে পাঠায়।
এছাড়াও পেশির মাঝে থাকে প্রোপ্রিওসেপ্টর (proprioceptor)। এরা বিভিন্ন অঙ্গের আপেক্ষিক অবস্থান এবং তাদের উপর প্রযুক্ত চাপের(stretch) অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরন করে। কিন্তু অক্টোপাসের এই রিসেপ্টর যথেষ্ট শক্তিশালী না। পরবর্তীতে আরও ব্যাখ্যা দিচ্ছি।
হাত দিয়ে স্বাদ?: চিন্তা করে দেখ তো হাত দিয়ে ধরলেই কোন বস্তুর স্বাদ পাওয়া গেলে কেমন হত? দুনিয়ার সব মজার খাবারের স্বাদ আমরা কেবল ধরার মাধ্যমেই পেতাম। কিন্তু মানুষ তা পারে না। অক্টোপাস পারে। শুঁড়ে অবস্থিত কেমোরিসেপ্টরের মাধ্যমে অক্টোপাস বুঝতে পারে কোন বস্তুর স্বাদ কেমন। এ পরীক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দ্রবণে ভেজানো স্পঞ্জ অক্টোপাসকে দিলো। কখনও মিষ্টি (চিনির দ্রবণ), কখনও টক (হাইড্রোক্লোরিক এসিডের দ্রবণ), কখনও আবার ক্ষারীয় দ্রবণ(কুইনাইন সালফেট দ্রবণ)। এতে দেখা গেল অক্টোপাসের কেমোরিসেপ্টর ভিন্ন দ্রবণের জন্য ভিন্ন সংবেদন তো দেখায়ই বরং তা মানুষের জিহ্বার থেকে ১০০গুণ তীব্র সংবেদন। অক্টোপাস তার কেমোরিসেপ্টরের মাধ্যমে পানিতে লবণের পরিমাণ, অম্লত্ব, ক্ষারত্ব প্রভৃতিও বুঝতে পারে।
বস্তুগত ব্যাপারস্যাপার: যেভাবে পরীক্ষা হল: কেবল স্বাদই না, অক্টোপাস তার স্পর্শানুভূতির মাধ্যমে সে কোনধরনের বস্তুর সংস্পর্শে আছে সে সম্পর্কেও ধারণা পায়। আগেই বলেছি অক্টোপাসের দেহে আছে একধরনের মেকানোরিসেপ্টর। এই রিসেপ্টর অক্টোপাসের মস্তিষ্কে সংবেদন পাঠায়। কিন্তু, অক্টোপাস যে চোখে দেখে বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে না তার নিশ্চয়তা কি? এজন্য পরীক্ষার আগে বিজ্ঞানীরা অক্টোপাসের অপটিক স্নায়ু (optic nerve) কেটে দেন। এতে অক্টোপাস তার দৃষ্টিশক্তি হারায়। এবার অক্টোপাসের শুঁড়ে বিভিন্ন ধরনের বস্তু স্পর্শ করিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
এতে দেখা যায় বস্তুর সংস্পর্শ পাওয়ামাত্র অক্টোপাস তার শুঁড়গুলো দিয়ে বস্তুটিকে জড়িয়ে ধরল। এরপর কেমোরিসেপ্টরের মাধ্যমে অক্টোপাস পরীক্ষা করে বস্তুটি খাওয়ার উপযোগী কিনা। খাওয়ার উপযোগী বস্তুকে অক্টোপাস তার মুখের ভিতরে চালান করে দেয়। কিন্তু, খাওয়ার অনুপযোগী বস্তুকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়।
যেভাবে কাজ করে ও মসৃণতার প্রভাব: কোন বস্তু কতটা মসৃণ, উঁচুনিচু বা খসখসে তা বোঝার জন্য আমরা কি করি? বস্তুটাকে ধরে দেখি। এতে বস্তুর পৃষ্ঠতল (surface) আমাদের হাতের ত্বকে অবস্থিত আবরণী কোষের (epithelial cell) আপেক্ষিক বিচ্যুতি (distortion) ঘটায়। মসৃণ বস্তুর ক্ষেত্রে আবরণী কোষগুলো একই তলে থাকে, কিন্তু, অমসৃণ বস্তুর ক্ষেত্রে থাকে উঁচুনিচু ভাবে। অক্টোপাসও একইভাবে কোন তল কতটা মসৃণ তা বুঝতে পারে। এই পরীক্ষা করার জন্য অক্টোপাসকে কিছু খাঁজকাটা সিলিন্ডার দেয়া হয়। খাঁজের সংখ্যা, অবস্থান এবং গভীরতা প্রত্যেকটা সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে ভিন্ন।
এবার বিভিন্ন সিলিন্ডারের প্রতি অক্টোপাসের প্রতিক্রিয়া কিরূপ তা পরীক্ষা করা হয়। খাঁজগুলো অক্টোপাসের মেকানোরিসেপ্টরের স্থানচ্যুতি ঘটায়। যে সিলিন্ডারের খাঁজ যত গভীর, সে তত বেশি স্থানচ্যুতি ঘটায়। কিন্তু, খাঁজ যদি কম গভীর হয় তবে কেবল খাঁজের সংখ্যা এবং অবস্থান ততটা স্থানচ্যুতি ঘটায় না। মেকানোরিসেপ্টরের আপেক্ষিক অবস্থানের উপর সংবেদনের তীব্রতা নির্ভর করে। মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইভাবে কাজ করে। কোন মসৃণ তলের উপর কোন অগভীর গর্ত আমরাও কিন্তু না খেয়াল করলে টের পাই না। আবার, সিলিন্ডারের ব্যাসও সেন্সরি সংবেদন সৃষ্টিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে সিলিন্ডারের ব্যাস বড় তার তলে চোষক যতটা ছড়িয়ে থাকবে, চিকন সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে কিন্তু ততটা থাকবে না। সিলিন্ডারটি চোষকের মাঝের কোষগুলোকে একধরণের চাপ দিয়ে রাখবে। অনেকটা আঙুল দিয়ে স্কেলের পাশের দিকটা চাপলে যেমন হয়। তাই দেখা যায়, মোটা সিলিন্ডারের থেকে চিকন সিলিন্ডার তীব্রতর সংবেদন সৃষ্টি করে।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, একইধরনের পৃষ্ঠতলের মসৃণতা মেকানোরিসেপ্টরকে একইভাবে স্থানচ্যুত করবে, তাহলে অক্টোপাস মসৃণ গোলক, ঘনক অথবা কোন মসৃণ তলের মধ্যে পার্থক্য করে কিভাবে? সত্যি বলতে এক্ষেত্রে অক্টোপাস তেমন একটা পার্থক্য করতে পারে না। গোলক কিংবা মসৃণ তলের ক্ষেত্রে সংবেদন কাছাকাছি হয়। কিন্তু ঘনকের ক্ষেত্রে সংবেদন ভিন্নরকম পাওয়া যায়, কারণ ঘনকের কোনা ভিন্নরকম সংবেদন তৈরি করে।
কিছু সীমাবদ্ধতা: এতক্ষণ গেলো মেকানোরিসেপ্টরের আপেক্ষিক অবস্থানের কথা। পরীক্ষা করে দেখা গেছে কোন বস্তুর তলে অবস্থানকালে চোষকগুলোর আপেক্ষিক অবস্থান অক্টোপাস অতটা ভাল বুঝতে পারে না। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, অক্টোপাস তার পেশিতে অবস্থিত প্রোপ্রিওসেপ্টরের থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী সংবেদন পায় না। একইধরনের তলের(texture) দুইটি ভিন্ন বস্তু অক্টোপাসকে দেয়া হল, যাদের একটার ওজন অপরটির থেকে বেশি। ভারি বস্তুটির ক্ষেত্রে অক্টোপাস বস্তুটিকে শুঁড় দিয়ে প্রচণ্ড শক্ত করে ধরল। হাল্কা বস্তুটির ক্ষেত্রেও অক্টোপাস ততটাই শক্তি প্রয়োগ করল যতটা ভারী বস্তুর ক্ষেত্রে করেছিল। মানুষ এমনটা করে না। ভারি বস্তুর ক্ষেত্রে আমাদের হাতের প্রোপ্রিওসেপ্টর যে সংবেদন সৃষ্টি করে, হাল্কা বস্তুর ক্ষেত্রে তা থেকে ভিন্ন সংবেদন সৃষ্টি করে। অক্টোপাসের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। তাই দেখা যায়, উভয় বস্তুর ক্ষেত্রেই অক্টোপাসের প্রতিক্রিয়া একই। অক্টোপাসের দুর্বল প্রোপ্রিওরিসেপ্টরই এর জন্য দায়ী। এসব কারণেই অক্টোপাস কোন বস্তুর আকার সঠিকভাবে বুঝতে পারে না।
প্রশিক্ষণের অকার্যকারিতা: এখানে আরেকটা ব্যাপার বলা ভাল। আমরা যখন কোন কাজ করি, যেমন হাঁটাচলা; আমাদের হাত-পা একই ভঙ্গিতে বারবার সঞ্চালিত হয়। এর কারণ হাত-পায়ে বিভিন্ন জয়েন্টের উপস্থিতি। এই জয়েন্টগুলো থেকে সংকেত আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছে এবং আমরা বুঝতে পারি কিভাবে হাত-পা সঞ্চালন করলে আমরা হাঁটতে পারব এবং আমরা তারই পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে হাঁটাচলা করি। কিন্তু, অক্টোপাসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। অক্টোপাসের শুঁড়ে কোন জয়েন্ট নেই। একারণে পেশির মধ্যকার প্রোপ্রিওসেপ্টর শুঁড়ের অবস্থান সম্পর্কে মস্তিষ্ককে অবগত করতে পারে না। এজন্য দেখা যায়, অক্টোপাসসহ অন্যান্য সকল নরম প্রানিই কিছু কাজ কখনই করতে পারে না।
এরকমই হাজারও বৈচিত্রে প্রানিজগত পূর্ণ। মানুষ কেবল তার অনুসন্ধানই করে যাচ্ছে।
Discussion about this post