অর্পিতা দাস
❝সুর্য্যি মামা ডুবেছে
ঐ যে জুজু আসছে।
–কি? অন্ধকারে জুজুর ভয়?
আজ থেকে আর নয়।❞
এমন কোন বাচ্চার খোঁজ পাওয়া খুবই দুষ্কর , যে অন্ধকারে ভূতের ভয় পাইনা। রাতের আঁধার দেখলেই তাদের মনে বিভিন্ন ধরনের আতঙ্কের হাতছানি, তাদের মনে হয় যেন ভয়ংকর কিছু এসে ধরে নিয়ে যাবে, নইতো ভয় দেখাবে।
আপনার আমার মতো প্রাপ্তবয়ষ্কদেকেও যদি বলা হয় যে, আলোকিত একটি রাস্তা আর অন্ধকার একটি গলি – এ দুটোর মধ্যে আপনি কোনটিতে বেশি স্বস্তি অনুভব করেন? খুব সম্ভবত আপনি আলোক ঝলমলে রাস্তাটিই পছন্দ করবেন।
কারণ অন্ধকার পরিবেশ আমাদের অবচেতন মনে বিভিন্ন ধরনের ভয় ও আশঙ্কার সৃষ্টি করে। এমনকি আপনি যদি ভূতে বিশ্বাস নাও করেন, তবুও।
কিন্তু অহেতুক ভয়ের অনুভূতিকেই কেন নাড়া দেয় আমাদের মস্তিষ্ক?
না, এটি মোটেইও অহেতুক নয়। নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দারুণ একটি বিষয় লক্ষ করলেন।
এই ভয়ের উদ্দীপনার সাথে সরাসরি সংযুক্ত রয়েছে মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যার নাম Amygdala.
এই অংশটি আমাদের আবেগ অনুভূতির নিয়ন্ত্রক এবং স্মৃতি সংরক্ষণেও সাহায্য করে, এরপর স্মৃতিগুলোকে আনন্দ, দুঃখ, বেদনা এরকম বিভিন্ন আবেগের সাথে সংযুক্ত করে।
যখন বিপদজ্জনক কোন পরিস্থিতি টের পায়, তখন এই অংশটি আমাদের মস্তিষ্কে ” Flight or fight ” সংকেত পাঠিয়ে আমাদের সতর্ক করে —”হয় তুমি পালিয়ে যাও, নয়তো পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করো”, এবং এই বিষয়টি হয় সম্পূর্ণ অবচেতনভাবে।
আসলে এই আচরণটির সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে আমাদের প্রাচীন গুহাবাসী পুর্বপুরুষদের। সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে রাত নেমে এলেই তাদের মনে সবসময় ভয় থাকতো এই গভীর অন্ধকারে কোনো দিক থেকে বুঝি কোনো প্রাণী হঠাৎ এসে তাদের উপর আক্রমণ করে বসবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের রাতের অন্ধকারেও “হয় যুদ্ধ করো নয়তো পালিয়ে বাঁচো” এই অস্বস্তিকর ও প্রতিরক্ষামূলক অনুভূতির নিয়ে রাত যাপন করতে হতো।অস্বস্তিকর হলেও, জীবনরক্ষকারী হাতিয়ার হিসেবে এটি ধীরে ধীরে তাদের ডিএনএ-তে গেঁথে গিয়েছিলো।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- যেসকল ইঁদুর বিড়ালকে ভয় পেয়ে সবসময় সচেতন থাকে তারাই বেশি দিন বেঁচে থাকে, আর যারা ভয় পাইনা তারা বিড়ালের থাবার শিকার হয়ে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর, বেঁচে থাকা ইঁদুরগুলো থেকে বিড়ালের প্রতি সংবেদনশীলতা পরবর্তী প্রজন্মগুলোতেও বয়ে চলে। সেজন্য যেসকল ইঁদুর কখনো বিড়াল দেখেনি তারাও দেখা যায় বিড়ালের সংস্পর্শে এলে পালিয়ে যায়।
আবার বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ কোন কিছুর প্রতি ভয় বা ফোবিয়া যে শুধু তাদের আশেপাশের মানুষজনকে দেখে শেখে তা নয়, তা সরাসরি জেনেটিক্যালি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে যেতে পারে। যেমন– জার্মানির প্রসিদ্ধ “ম্যাক্স প্ল্যাংক ইউনিভার্সিটি” –তে একটি স্নায়ুবিক পরীক্ষা করা হয়েছিলো মাত্র ৬ মাস বয়সের ৪৮ জন শিশুদের উপর। তাদেরকে সাদা পর্দার ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা বিভিন্ন ধরনের ছবি দেখানো হয়েছিলো। যখন ফুল, পাখি, মাছের ছবি দেখানো হচ্ছিলো তাদের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু যখন মাকড়সা আর সাপের ছবি দেখানো হচ্ছিলো তখন তাদের চোখ বারবার বড় বড় হয়ে যাচ্ছিলো। যদিও তারা আগে কখনো সাপ বা মাকড়সা দেখেনি বা তাদের দিয়ে আক্রমণের শিকার হয়নি। সুতরাং তারা জানেনা, প্রাণী দুটো আক্রমণাত্মক হতে পারে। কিন্তু তবুও এই অজানা দুইটি প্রাণীর প্রতি তারা ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখায়।এর একটা কারণ হতে পারে, প্রাচীন সময়ে মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে বাস করতো তখন তারা সাপ ও মাকড়সা এ দুটো প্রাণীর খুব কাছাকাছি বাস করতো। আর এ দুইটি প্রাণী এমন যে যারা এক কামড় বসালেই বিষাক্ত ছোবলে প্রাণ যেত। যে জন্য এদুটো প্রাণীর প্রতি প্রাচীন মানবদের বেশি সংবেদনশীল থাকতে হতো। আর কালক্রমে এদের প্রতি সেই প্রতিক্রিয়া একসময় তাদের সহজাত আচরণের রূপ নেয়।
আরো রোমাঞ্চকর বিষয় হচ্ছে, খুব সম্ভবত মাকড়সা বা সাপ দেখতে কেমন এটা জানার প্রয়োজন নেই, এদের ভয় পেতে। এদের শরীরের প্যাটার্নগুলো পর্যন্ত প্রজন্মের পর প্রজন্ম জেনেটিক্যালি আমাদের অবচেতন মনে সংরক্ষিত হয়ে আছে, যে কারণে ৬ মাসের বাচ্চাগুলোকে এদের ছবি দেখানো হলে এরা ভয়ের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছিলো।
ফোবিয়া নিয়ে এরকম আরো অনেক গবেষণা হলো। এ থেকে গবেষকরা একটা ধারণায় আসেন, ভয় বা ফোবিয়া জিনিসগুলো আপতদৃষ্টিতে দেখে মানসিক সমস্যা মনে হলেও, এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের শরীর, আমাদের DNA। হ্যাঁ, আমাদের পুর্বপুরুষদের থেকে ভয়ের অনুভূতিগুলো স্মৃতি আকারে বংশপরম্পরায় চলে আসতে পারে। আর, মাকড়সা ও সাপের থেকে অস্তিত্বকে রক্ষার মতো, অন্ধকারের প্রতি অজানা সেই ভীতিও হতে পারে পুর্বপুরুষদের ফেলে যাওয়া সেই প্রাচীন জীবনরক্ষকারী হাতিয়ার।
যাই হোক, অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকারের প্রতি ভয়ের সাথে বংশানুক্রমিক সংযোগ বা এপিজেনেটিকের কথা বলে আসছি। এবার সরাসরি অন্ধকার দেখলে আমাদের মস্তিষ্ক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় তা দেখা যাক!!
মোনাস ইউনিভার্সিটি এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির গবেষরা মানুষের মস্তিষ্কের উপর একটি পরীক্ষা (fMRI) করেন। সেই পরীক্ষাতে ২৩ জন স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়ষ্ক অংশগ্রহণ করেছিলো। এই পরীক্ষার মুল উদ্দেশ্য ছিলো মাঝারী আলো আর নিভু নিভু আলোতে আমাদের স্নায়ুকোষগুলো কি রকম প্রতিক্রিয়া দেয় তা বোঝার।
তো, এই পরীক্ষা থেকে একটা সত্য বের হয়ে আসে যে, Amygdala নামের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি কম আলোতে বেশি সক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু সাধারণ আলোতে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
এদিকে Amygdala আবার সংযুক্ত রয়েছে মস্তিষ্কের vmPFC নামের একটি জটিল অংশের সাথে। যা আবেগীয় অনুভূতি, ভয়, ঝুঁকি এসবকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে মৃদু আলোতে Amygdala যখন বেশি সক্রিয় হয়ে যায় আমাদের মনে নেতিবাচক অনুভূতিও বেশি উঁকি দেয়, ফলে মানসিক অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে থাকে।
এজন্য দেখা যায়, ডিপ্রেশনে থাকা দুর্বল মানসিকতার ব্যক্তিদের অনেক সময় “লাইট থেরাপি ” দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কারণ পরিমিত আলোতে আমাদের শরীরে সেরোটোনিনের মাত্রা ভারসাম্যে থাকে, কিন্তু অন্ধকারে এটি কমতে থাকে। ফলে ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তি চুপচাপ, মৃদু আলো, বদ্ধ পরিবেশে না থেকে খোলা ও আলোকিত পরিবেশে থাকলে সেরোটোনিন বেশি রিলিজ হয়, যার কারণে ধীরে ধীরে মানসিক প্রশান্তিও ফিরে আসতে পারে।
তো, ব্রেইন নিয়ে এতক্ষণ গল্পগুজবের সারমর্ম হলো-
১) যদি অন্ধকারে ভয় লাগে, এর পেছনে মূলত দায়ী আপনার মস্তিষ্কের Amygdala অংশটি। তাই ভয় পেলেও শান্ত থাকুন, নিজেকে আশ্বস্ত করুন বাস্তবে অন্ধকারে ভূত বা জুজু বলতে কিছু নেই। সবটা মস্তিষ্কের কারসাজি।
২) এক প্রজন্মের ফোবিয়া, ট্রমা, ডিপ্রেশন এই ধরনের মানসিক সমস্যাগুলো পরের প্রজন্মেও পৌঁছে যায় স্মৃতি আকারে। সুতরাং পিতা-মাতা যত সুস্থ মানসিকতার অধিকারী হবেন , সন্তানও তত সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন হবার সম্ভাবনা বেশি।
অর্পিতা দাস ,স্নাতক,পদার্থবিজ্ঞান
Discussion about this post