শেখ আনোয়ার
বোলতা এবং পিঁপড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গের নাম মৌমাছি। বাংলা সাহিত্যে মধুমক্ষিকা বা মধুকর হিসেবেও মৌমাছির আলাদা পরিচিতি রয়েছে। মৌমাছিকে আদর করে কবি প্রশ্ন করেছেন, মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি..?
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানান জাতের মৌমাছি দেখতে পাওয়া যায়। এরা সামাজিক প্রাণী। উঁচুগাছের ডাল, দালানের কার্ণিশ, গাছের ফাঁটল প্রভৃতি স্থানে এরা বড় বড় চাক নির্মাণ করে বসবাস করে। এক একটা চাকে ত্রিশ হাজার থেকে আশি হাজার মৌমাছি থাকতে দেখা যায়। এতো মৌমাছি একসঙ্গে বসবাস করলেও ওরা মানুষের মত এলোমেলো চলে না। ওদের স্বভাবের মধ্যে শৃঙ্খলা লক্ষ্যনীয়।
বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে যে প্রজাতির মৌমাছি চাষ করার উপযোগী তার নাম অ্যাপিস ইনডিকা। বাংলাদেশের আবহাওয়া প্রকৃতি অনুযায়ী ক্ষুদে আকৃতির এই মৌমাছি প্রজাতি গাছের কোটরে, দেয়ালের ফাঁটলে, বাক্সে ইত্যাদি আবদ্ধ স্থানে বাসা তৈরি করে। এদের উৎপাদিত মধুর মান খুবই উৎকৃষ্ট। মৌমাছির মধু ও মোম উৎপাদন এবং ফুলের পরাগায়ণের জন্য প্রসিদ্ধ। আন্টার্কটিকা ব্যতীত পৃথিবীর সব মহাদেশে যেখানেই পতঙ্গ পরাগায়িত সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে, সেখানেই রয়েছে মৌমাছি। পৃথিবীতে মৌমাছির প্রায় বিশ হাজার প্রজাতি রয়েছে। যদিও এর বেশিরভাগেরই কোনো বর্ণনা নেই। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।
প্রাণিজগত সাধারণত স্ত্রী ও পুরুষ এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। মৌমাছির ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষ মৌমাছি ছাড়াও আরেক শ্রেণির মৌমাছি দেখতে পাওয়া যায়। এরা হলো শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছি। এই শ্রমিক মৌমাছির জন্ম রহস্য বড় অদ্ভুত। চাকের হাজার হাজার মৌমাছির অধিকাংশই হলো শ্রমিক মৌমাছি। গবেষকরা লক্ষ্য করেন, মৌচাকে তিনরকমের মৌমাছি দেখা গেলেও বাস্তবে এরা একলিঙ্গ। বিচিত্র উপায়ে এদের লিঙ্গ নির্ধারণ হয়। নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে জন্ম হয় স্ত্রী মৌমাছির আর অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে জন্ম হয় পুরুষ মৌমাছি বা ড্রোন। রানি মৌমাছির ডিম পাড়ার জন্য মৌচাকে যে খালি কুঠুরিগুলো থাকে তার পরিমাপ বা আয়তন সমান হয়। ডিম পাড়ার সময় হলে রানি মৌমাছি চাকের উপর ঘুরে ঘুরে প্রতিটি খালি কুঠুরিতে একটি করে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়া শেষ হলে রানি মৌমাছির আর কোনো কাজ থাকে না।
এরপরে যাবতীয় কাজ শ্রমিক মৌমাছির উপর বর্তায়। ওরা ডিমের রক্ষণাবেক্ষণ করে। ডিম ফুটে বের হলে তাদের খাবার দেওয়া বাচ্চা প্রতিপালন করা সবই করে এই শ্রমিক মৌমাছি। ডিম ফুটে বের হলে তাদের খাবার হিসেবে দেওয়া হয় দুধ। মৌমাছির এই দুধকে বলা হয় রয়েল জেলী। শ্রমিক মৌমাছির শরীর থেকে নি:সৃত এক প্রকার ঘন সাদা তরল পদার্থের সঙ্গে ফুলের রেণু মিশিয়ে তৈরি হয় এই রয়েল জেলী। বাচ্চাগুলোকে খাবার দেওয়ার সময় সব কুঠুরিতে কিন্তু সমপরিমাণ খাবার দেওয়া হয় না। খাবারের পরিমাণ নির্ভর করে কুঠুরির আয়তনের উপর। বড় কুঠুরিতে যতটা খাবার দেওয়া হয়, ছোট কুঠুরিতে দেওয়া হয় অপেক্ষাকৃত কম খাবার। খাবারের পরিমাণের তারতম্যের ফলেই বাচ্চাগুলোর পুষ্টি লাভের তারতম্য ঘটে। বড় কুঠুরিগুলোর বাচ্চারা অধিক পুষ্টি লাভ করে রানি মৌমাছিতে রূপান্তরিত হয়। আর ছোট কুঠুরিগুলোর বাচ্চারা কম পুষ্টি লাভের ফলে প্রজনন যন্ত্রের যথাযথ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। এর ফলেই ছোট কুঠুরিগুলো থেকে উৎপন্ন মৌমাছিরা স্ত্রী জাতীয় হলেও তারা বন্ধ্যা অর্থাৎ সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়। এরাই হলো শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছি। রানি মৌমাছি দুই থেকে তিন বছর বাঁচলেও শ্রমিক মৌমাছির জীবন কাল মাত্র ছয় সপ্তাহ।
গবেষকদের তথ্য মতে, বয়স এবং অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কর্মী মৌমাছিরা চাকের যাবতীয় দায়িত্ব বহন করে। সাধারণত এক থেকে তিন দিন বয়সের কর্মী মৌমাছিরা চাকের ঘর পরিষ্কারের দায়িত্বে থাকে। বাচ্চাদের (লার্ভা) লালন পালনের দায়িত্বে থাকে চার থেকে নয় দিন বয়সের কর্মী মৌমাছিরা। দশ থেকে ষোল দিন বয়স হলে কর্মী মৌমাছিদের উপর দায়িত্ব পরে মৌচাকের ঘর তৈরির। ১৭-১৮ দিন বয়সের কর্মী মৌমাছিরা পরাগরেণু দিয়ে মধু তৈরি, ডানা দিয়ে বাতাস করে মৌচাক ঠান্ডা রাখা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকে। একুশ থেকে পঁচিশ দিন বয়সের কর্মী মৌমাছিরা রক্ষীর কাজের এবং পঁচিশ দিনের বেশি বয়সের কর্মী মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুল থেকে পরাগরেণু সংগ্রহ করে মধু তৈরি কাজের দায়িত্ব পালন করে।
চাক থেকে বেরিয়ে মধুর সন্ধানে যে কর্মী মৌমাছিগুলো উড়ে যায় তাদের বলে স্কাউট মৌমাছি। এদের উপরই দায়িত্ব থাকে অজস্র ফুলে ভরা বাগানের সন্ধান করা। যেখান থেকে পাওয়া যাবে বুক ভরা মধু। মনের মতো বাগানের সন্ধান পেলে স্কাউট মৌমাছি উড়তে থাকে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে। এর ফলে এদের শরীরে লেগে যায় ফুলের রেণু মধুর গন্ধ। বেশ কিছুক্ষণ বাগানের ফুলে ফুলে নাচানাচি করার পর স্কাউট মৌমাছি ফিরে চলে আপন বাসায়, অন্যদের খবর দেওয়ার জন্য।
মৌচাকে ফিরে এসে অন্যান্য মৌমাছিদের মধুর ভান্ডারের সন্ধান দেওয়ার জন্য স্কাউট মৌমাছি শুরু করে নাচানাচি। নাচ শুরু হলে অন্যান্য মৌমাছিরা শুঁড় দিয়ে স্কাউট মৌমাছির গা ঠেকিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে নাচের ধরণ। তারপর তারাও ধীরে ধীরে শুরু করে নাচ। এদের নাচের মুদ্রার নাম ওয়াগল ড্যান্স বা স্পন্দন নৃত্য এবং রাউন্ড ড্যান্স বা বৃত্তাকার নৃত্য ইত্যাদি।
নাচের এই ধরণই হদিস দেয় ভান্ডারের রাস্তার। বাগানের দূরত্ব এবং মধুর পরিমাণ। গবেষকরা বলেন, স্কাউট মৌমাছি যদি বাংলার চার অক্ষরের এর মত করে নাচে তবে বোঝা যাবে চাক থেকে বাগানটির দূরত্ব একশ মিটারের বেশি। আর যদি বৃত্তাকার পথে নাচে তবে বোঝা যাবে চাক থেকে বাগানটির দূরত্ব একশ মিটারের কম। এছাড়াও নাচের সঙ্গে সঙ্গে সে নাড়াতে থাকে তার লেজ। চাক থেকে বাগানের দূরত্বের উপর নির্ভর করে স্কাউট মৌমাছির লেজ নাড়ানো বা কোমর দোলানোর মাত্রা। দূরত্ব যতো বেশি হয় লেজ নাড়ানোর মাত্রা ততো কমে যায়। উপরন্তু, নাচের সময় সূর্যের অবস্থান অনুসারে স্কাউট মৌমাছিরা তার লেজ উলম্ব তলের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট কোণে বেঁকিয়ে রাখে। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনির্ভাসির্টির বিজ্ঞানী ড. অ্যাড্রিয়ান ওয়েনারের মতে, বাগানের মধু ভালো মানের এবং বেশি পরিমাণের হলে স্কাউট মৌমাছিরা জোরে ডানা ঝাপটিয়ে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করে।
মধু সংগ্রহের সঙ্গে মৌমাছির এই নাচের সম্পর্কে রহস্য উদঘাটন করেন কার্লভন ফ্রিৎস, কনরাভ লরেন্স, ও নিকো টিম্বারজেন। এজন্য ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয় এই তিন বিজ্ঞানীকে। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ভাষা যেমন আলাদা আলাদা থাকে। তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মৌমাছিদের নাচের ধরণও আলাদা আলাদা হয়ে থাকে।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post