অনলাইন ডেস্ক
পৃথিবীর বুকে সাতটি আশ্চর্য ছাড়াও এমন অনেক জিনিস আছে, যা নিয়ে মানুষের বিস্ময়ের শেষ নেই। এমনকি কিছু কিছু জিনিসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্যের সমাধান এখনও নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। এ রকম তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে পেরুর নাজকা লাইন।
পেরুর রাজধানী লিমা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাজকা মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এই নাজকা লাইন। প্রায় ৮০ কিলোমিটার লম্বা ও ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে এটি। এই বিশাল এলাকা জুড়ে মাটির উপর খোদাই করা রয়েছে বিভিন্ন রকম ছবি ও নকশা। পশু-পাখির ছবি ছাড়াও রয়েছে সরলরেখা ও জ্যামিতিক নকশা। মাটির উপরের এই বিশালাকার সব ভূচিত্রগুলিকেই বলে নাজকা লাইন।নাজকা মালভূমি জুড়ে অঙ্কিত এ সব ভূচিত্রগুলো এতো বিশাল যে, আকাশ থেকে না দেখলে সেগুলোর অবয়ব বোঝা যায় না। নাজকা রেখা দিয়ে তৈরি চিত্র বা নকশাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- জিওগ্লিফ এবং বায়োমর্ফ। বায়োমর্ফ বলতে বোঝায় জীবজগৎ অর্থাৎ পশু-পাখি বা গাছপালার ছবি। জিওগ্লিফ হল পৃথিবীর বুকে আঁকা জ্যামিতিক নকশা। নাজকার উপর প্রায় শতাধিক এমন জ্যামিতিক নকশা চোখে পড়ে।
এই নাজকা লাইন প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো। ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই নকশাগুলো তৈরি করা হয়েছিল বলে মত পুরাতত্ত্ববিদদের।
বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ চালু হওয়ার পর এই ভূচিত্র অধিকাংশ মানুষের নজরে এসেছে। কারণ একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা ছাড়া এর অবয়ব বোঝা সম্ভব নয়। তার পর গত ৮০ বছর ধরে রহস্যে মোড়া এই নাজকা লাইনের ব্যাপারে জানার চেষ্টা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৯৪ নাজকাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দিয়েছে ইউনেসকো।
পেরুর পুরাতত্ত্ববিদ তরিবিও মেজিয়া ঝেপসে প্রথম নাজকা নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা শুরু করেন ১৯২৬ সালে। ১৯৪০ সালে মার্কিন অধ্যাপক পল কোসোক নাজকা লাইনকে ‘পৃথিবীর সবথেকে বড় অ্যাস্ট্রোনমির বই’ বলেছেন। কোসোকের পর জার্মানির মারিয়া রিচি প্রায় ৪০ বছর ধরে নাজকা লাইন নিয়ে গবেষণা করেছেন। নাজকা লাইনের কাছে ছোট্ট ঘর বানিয়ে থাকতেন তিনি। নাজকা নিয়ে গবেষেণার জন্য তাঁকে ‘লেডি অব লাইনস’ বলেও ডাকা হত।
নাজকা লাইনের ওই অঞ্চলে ৮০০টি সরলরেখা, ৩০০ জ্যামিতিক নকশা ও ৭০টি প্রাণী ও উদ্ভিদের নকশা এখনও অবধি আবিষ্কৃত হয়েছে। কিছু কিছু সরলরেখা ৩০ মাইল পর্যন্ত লম্বা।
সরলরেখার পাশাপাশি ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, সামন্তরিকসহ বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশাও রয়েছে। মাকড়সা, হনুমান, হামিংবার্ড, হাঙর, সরীসৃপজাতীয় প্রাণীর বহু ছবি রয়েছে সারা নাজকা জুড়ে। নাজকায় প্রচুর পাখির নকশাও রয়েছে। বিশালাকার ১৬টি নকশায়, পাখিগুলোর ঠোঁট, ডানা ও লেজ আঁকা হয়েছে শরীরের তুলনায় অনেক বড় করে।
নাজকার জিওগ্লিফগুলোর সঙ্গে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের কোনও রীতির যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও মনে করেন গবেষকরা।
নাজকা লাইনের বহু রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। প্রথমত, প্রাকৃতির দুর্যোগের মোকাবিলা করেও কীভাবে অক্ষত রয়েছে এই সব নকশা? দ্বিতীয়ত, কীভাবে এই আঁকার কাজ সম্ভব হয়েছিল? তৃতীয়ত, কেন এগুলো তৈরি করা হয়েছিল?
পেরুর দক্ষিণ উপকূলের ২০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নাজকা সভ্যতা। মৃৎপাত্র ও পোশাক সেই সভ্যতার অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন। সেখানকার বাসিন্দারাই এই জিওগ্লিফগুলো এঁকেছিলেন বলে মত গবেষকদের।
কিন্তু কেন তাঁরা এগুলো আঁকলেন তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, এই জায়গায় আসার আগে নাজকারা যে সব প্রাণী দেখেছিল সেগুলোকেই তারা এভাবে এঁকেছে। কিছু চিত্র কাল্পনিক বলেও মত একাংশের বিজ্ঞানীদের।
নাজকা মরুভূমি অঞ্চলের উপরিভাগ লাল পাথরে মোড়া। সেই লাল পাথর সরিয়ে নীচের ধূসর রঙের পাথরের উপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জিওগ্লিফ। এর লাইনগুলো ১২-১৫ ইঞ্চি গর্ত করে তৈরি।
কিন্তু কী করে জিওগ্লিফের এই লাইনগুলো করা হয়েছিল, তার যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর এখনও মেলেনি। যে ক’টি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে তা নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
নাজকা লাইন এখনও এতটাই রহস্যময় যে, ভিনগ্রহীদেরও মানুষ জড়িয়ে ফেলেছে এই জিওগ্লিফের সঙ্গে।
কেউ কেউ মনে করেন, ভিনগ্রহীরা পৃথিবীর বুকে এঁকেছে এই ভূচিত্র। কেউ কেউ মনে করেন, এগুলো তাদের স্পেসশিপ রানওয়ে।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা।
Discussion about this post