মোস্তাফা জব্বার
৭ই জানুয়ারি ২০২১ বাংলাদেশের শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। ঐদিন প্রকাশিত সরকারী তথ্য বিবরণী থেকে তুলে ধরছি। ‘এইদিন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের টেলিকম অধিদফতর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাঝে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শুরু হলো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া। বিটিআরসির সার্ভিস অবলিগেশন তহবিলের অর্থায়নে হাওড়, প্রত্যন্ত, অনগ্রসর ও দুর্গম এলাকার ৬৫০টি স্কুলে এই প্রকল্প ২ বছরের মাঝে বাস্তবায়িত হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ৬৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল ক্লাসরুম ডিজিটাল হবে। এর মধ্যে ৩০টি স্কুলে শিশুরা বইবিহীন বা অনলাইনে ট্যাবে লেখাপড়া করতে পারবে। তাদের ক্লাসে ডিজিটাল টিভি, আইপিএস ও ইন্টারনেট থাকবে। তাদেরকে ২০২০ সালে ইনটেলের সঙ্গে উইটসা পুরস্কারপ্রাপ্ত ডিজিটাল কনটেন্ট দিয়ে পাঠদান করা হবে। ডিভাইস ও ইন্টারনেট থাকলে শিশুরা বাড়িতে বসে এবং অনলাইনেও ক্লাস করতে পারবে।
বেসরকারীভাবে ২০০০ ও ২০১৫ সালে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা দেশে চালু হলেও সরকারীভাবে কোন প্রকল্প গ্রহণ করে পাঠ্য বিষয়ের সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশন করে ডিজিটাল যন্ত্রের সহায়তায় প্রাথমিক শিক্ষার সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশন এই প্রথম।
বৃহস্পতিবার ৭ জানুয়ারি সচিবালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাকির হোসেনের উপস্থিতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এসময় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার অনলাইনে চুক্তি অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব গোলাম মোঃ হাসিবুল আলম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মোঃ আফজাল হোসেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এম মনসুরুল আলম এবং টেলিযোগাযোগ অধিদফতরের মহাপরিচালক মহসীনুল আলম বক্তৃতা করেন।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী শিশু বয়সকে সৃজনশীলতা ও মেধা অর্জনের সঠিক সময় উল্লেখ করে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে বইয়ের পরিবর্তে একদিন ট্যাব বা ডিজিটাল ডিভাইস পৌঁছে যাবে এবং সেদিন খুবই কাছে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে শতকরা ৮৮ভাগ শিশুর হাতে ট্যাব আছে। তাদের বইয়ের দিকে তাকাতে হয় না। প্রাথমিক শিক্ষা ডিজিটাল রূপান্তরের পথিকৃৎ জনাব মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনে সামান্য ফল দেবে কিন্তু প্রাথমিকের ডিজিটাল রূপান্তরে শতভাগ ফল পাওয়া সম্ভব। ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলাভাষা প্রবর্তনের পাশাপাশি কম্পিউটারে প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ’৮৭ সালে ৩২টি কেন্দ্র থেকে ডিজিটাল শিক্ষার জন্য ডিজিটাল সফটওয়্যার নিয়ে কাজ শুরু করলেও বাংলায় উপযোগী ডিজিটাল সফটওয়্যার তৈরি তখন সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমি উপলব্ধি করি এই বিষয়টির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া দরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গাজীপুরে সেই বছর ১৩ ছাত্রছাত্রী নিয়ে ২০০০ সাল থেকে দেশের প্রথম ডিজিটাল স্কুল নিয়ে যাত্রা শুরু করি। ‘অল্প দিনের মধ্যেই তিনি শিক্ষার্থীদের দক্ষতায় মুগ্ধ হলেন উল্লেখ করে বলেন, বাচ্চাদের হাতে পাঠ্য বিষয়টি বাংলায় কন্টেন্ট করে দেয়ার প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় হলিক্রসের ইংরেজী শিক্ষক জেসমিন জুইয়ের মাধ্যমে ২০১০ সালে তা সফলতায় রূপ নেয় এবং বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিকের তিনটি ও প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৫টিসহ মোট আটটি কনটেন্ট প্রাথমিক শিক্ষার ডিজিটালাইজেশনের যাত্রায় মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কোভিডকালে বিনা মাশুলে ডাউনলোড করে দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বাড়িতে বসে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে একবছরের পাঠ্যক্রম অনায়াসে একমাসে সম্পন্ন করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মন্ত্রী ডিজিটাল শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষার মূলস্রোতধারায় সংযুক্ত করতে ২০১৫ সাল থেকে তার গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরে আইসিটি বিভাগ থেকে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও নানা প্রতিকূলতায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দুর্গম অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত অসহায় শিশুদের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধ তহবিলের মাধ্যমে গৃহীত উদ্যোগ শিক্ষার রূপান্তরের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। এর ফলে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর এগিয়ে নেয়ার পথে পরবর্তী করণীয় ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে যা শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখবে। মন্ত্রী শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল শিক্ষা প্রবর্তনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, করোনাকালে অচল জীবনধারা সচল রাখার পাশাপাশি ঘরে বসে শিশুরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বড় দৃষ্টান্ত। ডিজিটাল শিক্ষা বিস্তারে আমরা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চাই।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব বলেন, শিক্ষায় ডিজিটাল রূপান্তরে যাত্রা শুরু হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এই যাত্রার সাঙ্গ হতে পেরে আমরা আনন্দিত।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরে পথ ধরেই সোনার মানুষ গড়ে উঠবে উল্লেখ করে বলেন, আগামী দিনের উপযোগী মানব সম্পদ গড়ে তুলতে ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
পরে প্রাথমিক অধিদফতর ও টেলিযোগাযোগ অধিদফতরের মহাপরিচালকদ্বয় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী সুবিধা বঞ্চিত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৬৫০টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ডিজিটালকরণ যাত্রা শুরু হবে। টেলিযোগাযোগ অধিদফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।’ বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার ডিজিটাইজেনের জন্য একটি প্রকল্প তাও মাত্র ৬৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে এতে আমার এত উল্লাস কেন? একটি বাক্যে বললে বলা হবে, এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের একটি দৃষ্টান্ত পাবে। দ্বিতীয়ত এই প্রকল্প শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের নতুন নতুন পথ পাবে। আমি নিজেই ভাবছি যে প্রকল্পটি গ্রহণ করলাম তার চাইতে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষাকে ডিজিটাল করা যায় কিনা। আশা করি সহসাই এই পথেও সফলতা পাব।
একটি ছোট্ট ঘটনায় এত বড় উল্লাসের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। আজকে হয়তো সেই ইতিহাস লিখতে পারব না তবে প্রকাশ তো করবই।
১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল যখন প্রথম কম্পিউটারের বোতাম স্পর্শ করি তখন কম্পিউটার চেনা তো দূরের কথা এর কিছুই জানা ছিল না আমার। আমার বিবেচনায় জানার দরকারও ছিল না। তখনকার দিনে বড় বড় কম্পিউটার ব্যবহৃত হতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানে। এগুলো ব্যবহার করতেন কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা। তখন মেকিন্টোস নামের এক ধরনের কম্পিউটার ডেস্কটপ প্রকাশনার জন্য ব্যবহৃত হতো। অন্যদিকে আইবিএম পিসি প্রধানত ওয়ার্ড স্টার লোটাস ডিবেসের জন্য ব্যবহৃত হতো। আমার নিজের প্রয়োজনেই আমি মেকিন্টোস স্পর্শ করি। কারণ মেকিন্টোসই একমাত্র বাংলা ভাষা লিখতে পারত। শ্রদ্ধেয় সাইফুদ্দাহার শহীদ ভাই ৮৬ সালে শহীদলিপি প্রচলন করেছিলেন। আশেকুর রহমান সাহেবের বিইএসএল কলকাতার রাহুল কমার্সের বাংলা ফন্ট দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আমি হাফিজ ভাইএর স্নেহের সুযোগে রাহুল কমার্সের ফন্টকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র সৈয়দ মাইনুল হাসানের বদৌলতে মাইনুল লিপিতে রূপান্তরিত করতে পারি। সেই সূত্র ধরে এ্যাপল কম্পিউটারের শিক্ষামূলক সফটওয়্যারের সাথে পরিচিত হই। এর মূল কারণ ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যাপলের শিক্ষামূলক সফটওয়্যার ব্যবহার করত আর আমরা তাদের মেরামতি সেবা দিতাম। বাংলাদেশে তখন কম্পিউটার শেখার হুজুগ ছিল। আমিও সংবাদপত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য মেকিন্টোস কম্পিউটারে ডিটিপির প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। তবে ’৯৭ সালে আমারিকার সানফ্রান্সিসকোতে ম্যাকওয়ার্ল্ড মেলায় যোগ দিয়ে ফেরার পথে ৪ বছরের ছেলে বিজয়ের জন্য মেকিন্টোস কম্পিউটারের জন্য তৈরি করা কিছু শিক্ষামূলক ডিজিটাল সফটওয়্যার কিনে আনি। মাত্র ৫০ ডলারে কেনা সেই সফটওয়্যার ছেলে বিজয় এর হাতে দেয়ার পর অনুভব করি এটি এক সোনার খনি। এরপর ’৯৯ সালে গাজীপুরে কম্পিউটারভিত্তিক আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল খুলি। পরের ২ বছরে দেশব্যাপী ৩২টি স্কুলের জন্ম হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় এর কনটেন্ট নিয়ে। কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি বাজারে পাওয়া যায় কিন্তু সেই কম্পিউটারে পড়ানোর জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট যার ভাষা বাংলা ও বাংলাদেশে পাঠ্য তা পাওয়া যায় না। ২০০০ সালের পর দেশব্যাপী বিরাজ করা আনন্দ মাল্টিমিডিয়া নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেই সফটওয়্যার তৈরি করা শুরু করলাম। কয়েকটি সফটওয়্যার তৈরিও হলো। কিন্তু আমার পছন্দ হলো না। পরিশেষে বিজয় ডিজিটাল নামক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তার দায়িত্ব কলেজ শিক্ষিকা জেসমিন জুইকে প্রদান করি। জুই বিজয় শিশু শিক্ষা নামে প্রথম সফটওয়্যার উপহার দিল ২০১০ সালে। এরপর সেটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োগের চেষ্টা করলাম ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ পূর্বধলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রীর হাতে ট্যাব দিতে পারলাম-কনটেন্ট দিতে পারলাম। ওরা ১ মাসে পুরো বছরের সিলেবাস শেষ করে ফেলল। ছাত্রছাত্রীরা অবাক হবে কি, শিক্ষিকা, স্কুল প্রশাসন তো বটেই আমি ও বিজয় ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী জেসমিন বিস্মিত হলাম। এটি আমাদের কল্পনার বাইরের বিষয় ছিল।
আজ ১০ তারিখ রাতে হঠাৎ করেই আমার মনে হলে শিক্ষার ডিজিটাইজেশনে আরও একটি প্রকল্প আমার হাতে আছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আমি আমাদের সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির মাধ্যমে আরও ৫০টি স্কুল ডিজিটাল করব। এবার প্রযুক্তিগত দিক থেকে এক পা এগিয়ে থাকব। গৃহীত প্রকল্পে আমরা ল্যাপটপ ও ট্যাব ব্যবহার করব। সাবমেরিনের প্রকল্প ল্যাপটপ বা সাবমেরিন ক্যাবল নয় ক্যাবল এন্ড্রয়েড টিভি আর বিজয় ডিজিটালের এন্ড্রয়েড সংস্করণের ডিজিটাল কনটেন্ট দেব। এর ফলে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ ব্যয় কমে যাবে ডিজিটাল ক্লাসরুম গড়ে তুলতে।
আমি বিশ্বাস করি আমরা যারা বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার জন্য এমন সব লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি তখন আমাদের শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর ঠেকায় কে? কোথায় প্রজেক্টর, ইন্টারএ্যাকটিভ বোর্ড আর কোথায় ক্যাবল একটা এন্ড্রয়েড টিভি। আমাদের মতো আর কেউ ভাববে বিশ্বাসই করি না।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
Discussion about this post