হোসাইন মোহাম্মদ সাগর
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয়ে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে, যা আগের অর্থবছরের থেকে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
করোনা মহামারির মধ্যেও দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তবে সেই প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের রেমিটেন্সকে আরও বাড়িয়ে নিতে দেশ থেকেই রেমিট্যান্স যুদ্ধে নেমেছেন লাখ লাখ তরুণ। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে তারা দেশে আনছেন তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। ফলে একদিক থেকে তারা যেমন নিজেদের সাবলম্বী করছেন, তেমনি বৃদ্ধি করছেন দেশের রেমিট্যান্স আয়। আর সরকারের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ফলে এই খাতে এখন ঘটে চলেছে নীরব বিপ্লব।
বর্তমানে দেশের অনেক কলেজ স্টুডেন্ট কোটিপতি হতে চলেছেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে। হাইস্পিড ইন্টারনেটের সঙ্গে হাই-টেক পার্ক ও বিভিন্ন আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার ফ্রিল্যান্সার এবং আইটি সেক্টরের উদ্যোক্তাদের জন্য স্বর্গরাজ্য পরিণত করেছে বাংলাদেশকে। ফলে এখন ঘরে বসেই অথবা স্বাধীনচেতা হয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন অনেকেই।
সম্প্রতি রাজশাহী ঘুরে দেখা যায়, নগরীতে কল-কারখানার গমগম আওয়াজ নেই, কিন্তু আইটি খাতে নীরব বিপ্লব শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন এখানকার উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে রাজশাহীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে হাইস্প্রিড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক। এই নগরীতে এখন ঘরে বসেই মাসে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন কেউ কেউ, এমন চিত্র হরহামেশাই মিলবে।
এ বিষয়ে রাজশাহীর একজন সফল উদ্যোক্তা ফ্লিট বাংলাদেশের সিইও খাইরুল আলম বলেন, রাজশাহীর বর্তমান পরিবর্তন অনেকের ভাবনাতীত ছিল। রাজশাহীতে কোনো শিল্প কারখানা নেই, যে কারণে বেকারত্ব পিছিয়ে রেখেছিল নগরকে। বর্তমানে রাজশাহীতে ডিজিটাল বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। আমার কোম্পানিতে কাজ করে মাসে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছে এমন স্টাফের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো।
তিনি বলেন, আমরা অ্যামাজন, ওয়ালমার্টের মতো বেশকিছু ওয়ার্ল্ড জায়ান্টের স্টোর ম্যানেজমেন্টের কাজ করছি রাজশাহীতে বসে। আমাদের তরুণরা দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করছে। আমাদের কোম্পানিতে এখন ৫৫৩ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। অনেক স্টাফের রোজগার নামি-দামি কোম্পানির সিইওয়ের চেয়েও বেশি। অনেক কলেজ ছাত্রী মাসে দুই-তিন লাখ টাকার ওপরে আয় করছেন যা অন্য চাকরিতে চিন্তারও বাইরে। আরও অবাক করা হচ্ছে নিজের বাড়িতে বসে এই আয় করতে পারছেন তারা। এতে করে একদিকে যেমন এই মানুষগুলো নিজেদের স্বাবলম্বী করছেন, তেমনি বিদেশের টাকা দেশে এনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন রেমিট্যান্স খাতেও।
রাজশাহী টেক লিমিটেডের সিইও মাহফুজ রহমান বলেন, হাই স্পিড নেট বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে রাজশাহীতে। সারাদেশের ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড কানেকশন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। আগে কাজ শুরু করার পর হঠাৎ নেট স্পিড ডাউন হয়ে যেত, এতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। কলকারখানা কিংবা নগরায়নের প্রভাব ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কিন্তু সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের উদ্যোগ প্রতিটি গ্রামকে বদলে দিয়েছে। এখন মোবাইল গেমস তৈরির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। সারা দুনিয়ার সব সিনেমা জগত, সব খেলার জগত একত্র করলে যে টার্নওভার হবে তার চেয়ে মোবাইল গেমসের বাজার অনেক বড়। এর মার্কেট সাইজ হচ্ছে ৬ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। দিন দিন বাড়ছে বিস্তৃতি। বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় দর কম হওয়ায় উদ্যোক্তারাও বাংলাদেশে কাজ দিচ্ছে।
এদিকে যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে অনেকেই এর স্পেস ব্যবহার করে এগিয়ে চলতে শুরু করেছেন। ভবনটির ১০ম তলায় নিজেদের অফিস বরাদ্দ নিয়ে কাজ করছে যশোর আইটি। এই প্রতিষ্ঠানটির সিইও রাকিব হাসান বলেন, দৃশ্যমান অফিসের বিষয়টি বায়ারদের আস্থা বাড়িয়ে দেয়। আমরা এখানে অফিস স্থাপনের পর অনেক বড় বড় কাজ পাচ্ছি। আমার কোম্পানিতে প্রায় শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বছরে প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার প্রায় দুই কোটি টাকা।
স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী নাহিয়া ইসলাম শখের বসে এসেছিলেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে। এখন নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কথা হলে বলেন, আমাদের সংসারে তেমন অভাব-অনটন নেই, তবে নিজে কিছু করতে চাই সে কারণে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হই। সরকারের লানিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্প থেকে ট্রেনিং নেই। পরে আমার দেখাদেখি বড় বোনটিও এই কাজে এসেছে এবং ভালো করছে। এরই মধ্যে আমরা তিন হাজার ডলার জমা করেছি। আমরা দুই বোন মিলে আইটি সেন্টার করার পরিকল্পনা নিয়েছি। যেখানে ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ থাকবে।
এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, সুলভমূল্যে ইন্টারনেট, সরকারের সকল সেবাকে ডিজিটাল করা এবং একটি আইসিটি শিল্পের বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। সে লক্ষ্যে আইসিটি পলিসিও নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট দেওয়া হবে, এটি ২০০৯ সালে আইসিটি পলিসিতে দেওয়া হয়েছে। আমরা যে টু-জি থেকে থ্রি-জি এবং ফোর-জিতে যাবো, সেটিসহ একটি বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা এবং ওয়ার্ক প্ল্যান সেখানে রয়েছে। ইন্টারনেটের দাম ৭৮ হাজার টাকা এমবিপিএস থেকে কমিয়ে ২০০ টাকার নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। এরপর আমরা সকলকে সুলভমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে পেরেছি। যদি ঢাকার বাইরে তিন হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্যাল কেবল না যেত, তাহলে এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ১২ কোটিতে পৌঁছাতো না। যে ইউনিয়নে বিদ্যুৎ ছিল না, সোলার বিদ্যুতের মাধ্যমে সেখানেও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলোর সুফল আমরা এখন পাচ্ছি।
এর আগে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্য দিন বদলের উপাখ্যান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’র স্বপ্ন উপস্থাপন করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন সেই স্বপ্ন ধরা দিয়েছে বাস্তবতায়।
Discussion about this post