তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
ডিজিটালাইজেশন এখন বৈশ্বিক বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। হাত বাড়ালেই ডিজিটাল ডিভাইস। বেড়েছে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধও। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ অপরাধের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। দেশে সাইবার অপরাধের শিকার বেশিরভাগই তরুণী। তবে বয়স্ক নারীরাও এখন হয়রানির বাইরে নেই।
প্রথম দিকে সাইবার ক্রাইমের শিকার তরুণীরা নিজেদের করণীয় সম্পর্কে না জানায় নিরূপায় হয়ে ঘরে বসে থাকতেন। তবে এ ধরনের অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও সচেতনতা বাড়ানোর নানান কর্মসূচি কাজে এসেছে। এখন প্রতিদিন অসংখ্য ভুক্তভোগী অভিযোগ নিয়ে হাজির হচ্ছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে। পুলিশের তাৎক্ষণিক তৎপরতায় সাহস পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরাও।
জাগো নিউজ: নারীরা সবচেয়ে বেশি কীভাবে সাইবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন?
কামরুল আহসান: ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের একটি বড় অংশ হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নারীদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা, যাকে বলা হয়- কম্প্রোমাইজ হয়ে যাওয়া। অথবা নারীদের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করা। যেসব নারী ফেসবুক বা অন্য মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইডির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পেজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অপরাধ বেশি হয়। এছাড়া সাইবার বুলিং, অনাকাঙ্ক্ষিত কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার মতো অপরাধের শিকারও হচ্ছেন নারীরা। পুলিশের কাছে তরুণীদের যত অভিযোগ আসে, তার অধিকাংশই প্রেমঘটিত সাইবার ক্রাইম। এসব ক্ষেত্রে তাদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সাইবার ক্রাইম এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে, ভয়-লজ্জা পেয়ে বসে থাকলে চলবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সময় ভুক্তভোগীদের সাইবার হয়রানির শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। অভিযোগ পেলে দ্রুত তা সমাধানের চেষ্টা করে।
জাগো নিউজ: কোন কোন মাধ্যমে নারীরা বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন?
কামরুল আহসান: ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টিকটক, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোর মাধ্যমে নারীরা সাইবার অপরাধীদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাইবার বুলিং। নারী ও শিশুরা এর প্রধান শিকার। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কারও ব্যক্তিগত দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করা। কিশোর-কিশোরীরাই প্রথমদিকে এ ধরনের হয়রানির শিকার বেশি হচ্ছিল। এখন মধ্য বয়সীরাও এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
জাগো নিউজ: কোন বয়সের নারীরা সাইবার অপরাধীদের টার্গেটে বেশি পরিণত হচ্ছেন?
কামরুল আহসান: গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফেসবুকে অন্তত ২০ হাজারের বেশি নারী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমাদের নির্ধারিত অফিসিয়াল নম্বরে ফোন কল এসেছে প্রায় আট হাজারের মতো। ফোনে দুই হাজার ৭শর বেশি এ ধরনের সমস্যার সমাধান করেছি। সাড়ে তিনশোর বেশি অভিযোগ আমরা লিখিতভাবে নিয়েছি। এর মধ্যে নারীদের হয়রানি, উত্ত্যক্ত, ব্ল্যাকমেইল, প্রতারণা করার ঘটনা বেশি। তাদের মধ্যে বেশি রয়েছে টিনএজ মেয়েরা। অর্থাৎ যারা বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। অনেক ক্ষেত্রে ৩০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীরাও এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তবে আমাদের এসব হিসাবের বাইরেও অনেক নারী আছেন, যারা লোকলজ্জার ভয়ে অভিযোগ করতেই চান না।
জাগো নিউজ: কী ধরনের অভিযোগ বেশি আসছে?
কামরুল আহসান: নানাভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন নারীরা। তাদের ছবি এডিট অর্থাৎ সম্পাদনা করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা প্রেমের সম্পর্কে গভীরতায় গেছে, সেটাকেই পরবর্তী সময়ে পুঁজি করছে আর্থিক লাভের আশায়। সম্পর্কটা নষ্ট করে দিয়ে বলছে টাকা না দিলে ছবি কিংবা ভিডিও ভাইরাল করে দেবো। দেখা যাচ্ছে, বাবা-মা রক্ষণশীল, সেক্ষেত্রে মেয়েটা অসহায় হয়ে পড়ছে। তখন হয়তো একটা অবৈধ প্রস্তাব দিচ্ছে। প্রস্তাবে জড়ালে ফের প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে। বিষয়টি খুবই ভয়ংকর। পরিবারের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাবে কীভাবে- এমন চিন্তা থেকে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করেন না। অন্তরঙ্গতার কতটুকু যাবো, বন্ধুত্বের কতটুকু জায়গা পর্যন্ত আমি মেনটেইন করবো—এগুলোর সীমা থাকাটা জরুরি। সামাজিক অনুশাসন মেনে চলাটাও অত্যন্ত জরুরি।
জাগো নিউজ: নারীরা বেশি হয়রানির শিকার হওয়ার পেছনে কারণ কী?
কামরুল আহসান: মেয়েরা একটু বেশি ইমোশনাল হয়। সহজে অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কোনো নারী তার বন্ধুর সঙ্গে হয়তো নিজের ইচ্ছায়ই একসঙ্গে ছবি তুলেছে অথবা শেয়ার করেছে। যে সময় তিনি এটা করেছেন, তখন সম্পর্কটা হয়তো খুবই ভালো ছিল। এক-দু’বছর পর এর খেসারত দিতে হয়। যখন সম্পর্কটা খারাপ হয় বা তৃতীয় কোনো পক্ষ ঢুকে পড়ে। সম্পর্কে জড়ালেও সবাইকে নিজের নিরাপত্তার জায়গাটা নিশ্চিত রেখেই তা চালিয়ে নেওয়া উচিত। অর্থাৎ ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে এমন কোনো ছবি-ভিডিও প্রিয়জন হয়ে ওঠা ব্যক্তির সঙ্গে শেয়ার করা উচিত নয়। ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিজেকে প্রোটেক্ট করতে হবে, শিখতে হবে। এসব বিষয় আইনের ফাঁকফোকরের চেয়ে পারিবারিক ও মূল্যবোধের শিক্ষাটা জরুরি এবং পরিধিটা বাড়াতে হবে। তাহলে এসব ট্রমা থেকে মেয়েরা মুক্তি পাবে।
জাগো নিউজ: সাইবার হয়রানি প্রতিরোধে কিশোরী বা তরুণীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
কামরুল আহসান: সাইবার ক্রাইম কমাতে পলিসি পর্যায়ে হাত দিতে হবে। ছোটবেলা থেকে শিশুদের এ শিক্ষাটা শুরু করা জরুরি। তাদের বলতে হবে ক্যামেরায় তোমরা নিজের যে চেহারাটা দেখছো, সামাজিক মাধ্যমেও তোমার সেই একই চেহারা অন্যরা দেখছে। সেখানে তুমি যে মন্তব্য করছো বা অনুভূতির কথা লিখছো-শেয়ার করছো, সেগুলোও তোমার চেহারার প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ সামাজিকমাধ্যম কিংবা অনলাইনে তুমি যে কোনো কাজ করার আগে নিজের চেহারাটার কথা ভাবো। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে, সাইবার অপরাধের খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রাথমিক স্তর থেকেই পাঠ্যপুস্তকে একটি চ্যাপটার (অধ্যায়) যুক্ত করা। এটি যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে, ততই মঙ্গলজনক।
জাগো নিউজ: শিশু অথবা শিক্ষার্থীদের হাতে ডিভাইস না দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?
কামরুল আহসান: বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে অবশ্যই প্রযুক্তিবান্ধব হতে হবে। তবে যে কোনো ডিভাইস ব্যবহারের আগে এর ক্ষতিকর দিকটিও জানতে হবে। অভিভাবকরা অনেক সময় টেকনোলজি সম্পর্কে জানেন না, তারা শিখতেও চান না। বাচ্চাদের হাতে ডিভাইস দেওয়ার আগে এর সম্পর্কে অভিভাবকদেরও বুঝতে হবে। তারপর বাচ্চাদের হাতে দিতে হবে। তাদের হাতে দেওয়ার আগে ফিল্টারিং করা যেতে পারে। সে কী কী দেখবে, আর কী কী দেখতে পারবে না, তা বলে কিংবা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ আপনার বাসার ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক বা মোবাইল অথবা ডিজিটাল ডিভাইসে কিছু সাইট ব্লক করে দিতে পারেন। সেগুলো রেগুলার মনিটরিং করা যেতে পারে। ধীরে ধীরে টেকনোলজি সম্পর্কে যখন বাচ্চা বুঝতে শিখবে, তখন সেই শিশুটি বড় হয়ে সাইবার হয়রানি রুখতে সক্ষম হবে। তার ছোটবেলা থেকে মানসিকভাবে এ বিষয়ে জেনেশুনে বেড়ে উঠবে।
জাগো নিউজ: হয়রানির শিকার নারীদের জন্য পরিবারের ভূমিকা কেমন হতে পারে?
কামরুল আহসান: শিক্ষার্থীদের ব্রাউজ হিস্ট্রি যদি মা-বাবা দেখতে পারেন, তাহলে খুবই ভালো হয়। ভিপিএন যদি ব্যবহার করে, তাহলে যে জায়গাগুলোতে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানেও যে কেউ যেতে পারে। যদি ব্রাউজ হিস্ট্রি দেখেন, তাহলে এগুলো বুঝতে পারবেন। সামাজিক শিক্ষাটা ডিজিটাল ফরম্যাটে নিয়ে এলেই হবে। মানুষ ভুল করতেই পারে। সংশোধনের জায়গাও আছে। বাবা-মাকে অবশ্যই সন্তানকে বোঝাতে হবে। দরকার হলে যে জায়গায় সমস্যা মনে করছেন, সেটা নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। যারা হ্যারাসমেন্টের শিকার হচ্ছেন, তাদের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ঝড়ের বেগে দেখানো উচিত হবে না। ভুক্তভোগীদের কিছুটা সময় দিতে হবে। ধীরে ধীরে তাদের বোঝাতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তাদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।
জাগো নিউজ: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিরাপদ করার উপায় কী?
কামরুল আহসান: এক পাসওয়ার্ডে মাসের পর মাস চলতে পারবেন না। সিকিউরিটির জন্য এটা দরকার। বিশেষত নারীরা সহজেই যে কোনো কিছু বিশ্বাস করেন। তারা আর্থিক প্রতারণার শিকার বেশি হন। মোবাইলে ব্যক্তিগত কিছু স্টোর করে না রাখাই ভালো। যে অংশগুলো একদম ব্যক্তিগত, সেগুলো হার্ডডিস্কে সরিয়ে নেওয়া ভালো। যে কোনো সময় আপনার মোবাইলটি হারিয়ে যেতে পারে, তখন স্টোরে থাকা ডেটাগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এ রকম ঝুঁকির মধ্যে অনেকে পড়েছেন। অনেকের ব্যক্তিগত ছবি এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, টাকা-পয়সা দিয়েও তারা রক্ষা পায়নি। এসব ঘটনার প্রভাব খুব ভয়াবহ। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরেপড়া, মাদকসেবন ও আত্মহত্যার মতো ঘটনাও আমরা দেখেছি। সবকিছুর পরে বলতে চাই, সাইবার অপরাধ থেকে সন্তানকে বাঁচাতে মা-বাবার দায়িত্বটা সবার আগে। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে শেখানো জরুরি। সৌজন্যে-জাগো নিউজ
Discussion about this post