নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের কম্পিউটার প্রোগ্রামার জোশ ওয়ের্ডল এই খেলাটি তৈরি করেছেন। জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসের টেকনোলজি সেকশনে ওর্ডল নিয়ে যে প্রতিবেদন, সেখানে সেটির শিরোনাম দেওয়া হয়—ওর্ডল ইজ অ্যা লাভ স্টোরি। কারণ, জোশ ওয়ের্ডল তাঁর সঙ্গী পলক সাহাকে খুশি করার জন্য এই খেলাটি তৈরি করেন। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, ওয়ের্ডল ২০১৩ সালে প্রথম শব্দ অনুমানের এমন একটি খেলা তৈরি করেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গী অভিভূত না হওয়ায় তিনি প্রজেক্টটি বাতিল করেন। ২০২০ সালে তাঁরা দুজনই নিউইয়র্ক টাইমসের বানানের খেলা ‘স্পেলিং বী’ ও প্রতিদিনের শব্দভেদ সমাধানে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ‘কাজে আমি এমন একটা গেম বানাতে চেয়েছি যা সে উপভোগ করবে’—নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন ওয়ের্ডল।
নিজেরা কিছু দিন খেলার পর এই দম্পতি তাঁদের পারিবারিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এটি শেয়ার করেন। সেখানে এটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর ওয়ের্ডল এটিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিন। গত বছর নভেম্বরের ১ তারিখে মোট ৯০ জন এই শব্দ অনুমানের খেলায় অংশ নেন। তারপর থেকে এটির ব্যবহার ক্রমে বাড়তে থাকে। জানুয়ারির শুরুতে দৈনিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয় তিন লাখ।
পলক সাহা তাঁর প্রোগ্রামার বন্ধুকে শুধু উদ্বুদ্ধই করেননি; বরং তাঁকে সাহায্য করেছেন অব্যবহৃত শব্দগুলো বাদ দিয়ে ডেটাবেইস সহজ শব্দে সমৃদ্ধ করতে। প্রায় ১২ হাজার শব্দের একটি ডেটাবেইস তাঁরা তৈরি করেছেন।
ইন্টারনেটের অন্য ১০টি জনপ্রিয় গেমের তুলনায় এটি একেবারেই ভিন্ন। বিশ্লেষকদের মতে, এই গেমের তুমুল জনপ্রিয়তার জন্য এ কারণগুলোই মুখ্য।
ক. কোনো অ্যাপ স্টোর নেই, কোনো ব্যক্তিগত তথ্য নেই: এটি খেলার জন্য আপনাকে মোবাইল ফোনে কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে না। নিজের নাম, ঠিকানা ও বৃত্তান্ত দিয়ে কোনো অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে না। শুধু একটি ডিভাইস, যা দিয়ে ওয়েব ব্রাউজ করা যায়, সেটি দিয়েই আপনি খেলতে পারবেন।
খ. দৈনিক মাত্র একটি শব্দ : এই খেলাটি আপনাকে কোনো একটি চক্করে ফেলে না। এর কোনো পরের রাউন্ড নেই। একের পর এক নতুন শব্দ বের করতে হয় না। এটি আপনাকে কোনো নোটিফিকেশন পাঠায় না। ২৪ ঘণ্টায় মাত্র একবার খেলা যায়।
গ. কোনো ‘পয়েন্ট’ নেই : না এই খেলায় জিতে আপনি কোনো পয়েন্ট অর্জন করতে পারবেন না। সেই ‘পয়েন্ট’ জমিয়ে আপনি কোনো কেনাকাটাও করতে পারবেন না।
ঘ. কোনো বিজ্ঞাপন নেই : ওর্ডলের ওয়েবসাইটে কোনো বিজ্ঞাপন নেই।
এ ছাড়া অল্প সময়ের মধ্যে এতে সফল হওয়া যায় যা কি না, যে কাউকে একটি চ্যালেঞ্জ জয়ের তৃপ্তি দেয়। ফলে, অন্যান্য কাজেও সফলতার হার বাড়ে। মার্কিন নৌবাহিনীর সদস্যদের এ জন্যই সকালে নিজেদের বিছানা প্রস্তুত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। যাতে একটি কাজ সম্পূর্ণ করার তৃপ্তি পাওয়া যায়। ওর্ডলও তার ব্যবহারকারীদের এ রকম সুযোগ দিচ্ছে। বলা বাহুল্য খেলাটা মোটেও কঠিন নয় বলেই বিশ্বব্যাপী ধারণা।
এই খেলাটির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ‘নির্মল আনন্দ’। নিউইয়র্ক টাইমসকে ওয়ের্ডল যেমনটি বলেছেন—‘শুরুর দিকে ইন্টারনেট কেবলই আনন্দের একটি ব্যাপার ছিল। আমি সে রকম একটি আনন্দের ব্যাপার করতে চেয়েছি।’ কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে ওয়ের্ডল আরও অনেক গেম ও প্রজেক্ট করেছেন। তবে এটি তাঁর নিজের প্রজেক্ট যা তিনি একা একাই করেছেন। কারও সাহায্য নেননি।
ওর্ডলের মতো অনেক শব্দ খোঁজার খেলা ইন্টারনেটে আছে। কিন্তু যেহেতু ওয়ের্ডল গেমটি নিজেদের জন্য বানিয়েছেন, তাই এতে কোনো ‘গ্রোথ হ্যাকিং ফিচার’ রাখা হয়নি। খেলোয়াড়কে পরদিন ডেকে আনার কোনো চেষ্টা এখানে নেই। ওর্ডলের ব্যবহারকারীদের সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্ক স্থাপনের কোনো চেষ্টাও ওয়ের্ডলের নেই। তার মতে, এটি এমন কিছু যা আপনার মিনিট তিনেক সময় নিয়ে আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছে।
ডিসেম্বর পর্যন্ত ওর্ডলের ফলাফল শেয়ার করার কোনো সিস্টেম ছিল না। এ সময় নিউজিল্যান্ডের এক নারী টুইটারে প্রথম ইমোজি ব্যবহার করে রেজাল্ট শেয়ার করেন। এটা দেখার পর ওয়ের্ডল সেটাই গেমে যুক্ত করে দিয়েছেন। তারপর থেকে এটি বিপুল বিক্রমে ছড়িয়ে পরতে শুরু করে।
ওর্ডলে শব্দ খোঁজার খেলাতে সফল হওয়ার বেশ কিছু কৌশল রয়েছে। দাবা খেলার মতো প্রথম শব্দ নির্বাচনে কুশলী হতে পারলে দ্রুত সমাধানে পৌঁছানো যায়। ইংরেজি ভাষাতে মাত্র পাঁচটি স্বরবর্ণ (a, e, i, o, u) আছে। কাজেই আপনি যদি শুরুতে স্বরবর্ণগুলো বের করে ফেলতে পারেন, তাহলে কাজটা এগিয়ে যায়। এ জন্য অনেকেই চারটি স্বরবর্ণওয়ালা শব্দ, যেমন AUDIO, ADIEU কিংবা QUERY। তারপর সেখান থেকে এগোনো সহজ। ঢাকার প্রকৌশলী আহমেদ শাহরিয়ার তিনটি শব্দ খুঁজে নিয়েছেন, যেগুলো ১৫টি ভিন্ন ভিন্ন অক্ষর নিয়ে গঠিত। সেখান থেকে তিনি এগোতে পারেন। কেউ কেউ আগের দিনের সমাধান দিয়ে শুরু করেন। স্বরবর্ণ বোঝার পর খেয়াল করতে হয় ব্যঞ্জনবর্ণের। ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ব্যঞ্জনবর্ণ হলো T, N, S, R, H ও L। এসব বর্ণ দিয়ে তৈরি শব্দ ব্যবহার করেও আপনি মোক্ষ লাভ করতে পারেন।
কেন খেলে?
এটি কত জনপ্রিয় হয়েছে, সেটির একটি নমুনা হলো গুগল! ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজার এই ওয়েবসাইটে ‘wordle’ খুঁজলে গুগল মজার একটি কাজ করে। গুগলে wordle লিখে আপনি সেটা দেখে নিতে পারেন।
বিশ্বের প্রায় সব জনপ্রিয় গণমাধ্যম ওর্ডল নিয়ে কোনো না কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিখ্যাত কলাম লেখক ও ভাষা বিশেষজ্ঞরা এই খেলায় জেতার কৌশল নিয়ে নিবন্ধ লিখছেন। এই খেলার অনুকরণে এর মধ্যে প্রায় ৫০টির মতো খেলা তৈরি হয়েছে। এর কোনোটি মৌলিক সংখ্যা খুঁজে, কোনোটি জোড়া শব্দ খুঁজতে বলে। বেশির ভাগ ভাষার জন্য সেই ভাষার ওর্ডল ভার্সন তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে কীভাবে আপনি এই খেলার ফলাফল আগেই জেনে নিতে পারেন তার উপায়। তবে, নিবিষ্ট মনে যাঁরা খেলছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আগেভাগে উত্তর জেনে নিতে আগ্রহী নন।
সহজ সাধারণ এই খেলাটি এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কী?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশি যাঁরা খেলছেন, তাঁরা খেলার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। বেশির ভাগই বলেছেন-নির্মল আনন্দ পাচ্ছেন। নিজেরটার পাশাপাশি অন্যদের ফলাফলের গ্রিড দেখে তাঁদের শব্দগুলোও অনুমান করা যাচ্ছে। পাশাপাশি নিজেদের শব্দভান্ডারও সমৃদ্ধ হচ্ছে। কেউ কেউ বলেছেন, তারা ‘ট্রেন্ডের’ সঙ্গে থাকার জন্য শুরু করলেও এখন মজার জন্যই খেলছেন।
রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রতিদিন নতুন শব্দ পাওয়া যায়। এ জন্য অনেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তারপর সমাধান করে ঘুমাতে যান। এই দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন অনেক ফ্রিল্যান্সার। ফ্রিল্যান্সার অনেকেরই রাত জেগে কাজ করতে হয়। তারপর ঘুমাতে যাওয়ার আগে এটি খেলেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নিজের পর্বটি শেষ করেন, এমন লোকের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।
তবে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সবাই জেতার জন্যই মনে হয় খেলছেন। সপ্তাহখানেক ধরে টুইটার ও ফেসবুকে যাঁরা তাঁদের ফলাফল শেয়ার করছেন, তাঁদের মনোযোগ দিয়ে আমি অনুসরণ করছি। দেখেছি, কেউ তাঁদের অসফলতার কথা শেয়ার করছেন না। তাঁদের প্রলুব্ধ করার জন্য আমার দুই দিনের ব্যর্থতার ফলাফলও আমি শেয়ার করেছি। কিন্তু কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পারিনি। এ ছাড়া ইন্টারনেটে প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, কমবেশি সবাই জেতার জন্য খেলছেন এবং জিতলেই কেবল শেয়ার করছেন।
আমার নিজের ধারণা হলো, যেহেতু এই খেলাতে আপনার কোনো প্রতিপক্ষ নেই, তাই ‘যুদ্ধ জয়ের একটি কৌশল’ নিয়ে ওর্ডল খেলার দরকার নেই। আপনি আপন খুশিতে এটা খেলতে পারেন। ছয়বারের মধ্যে পারলে পারলেন, না পারলেও ক্ষতি নেই। জীবন সবকিছুতে লাভক্ষতির জন্য নয়। তার চেয়ে অনেক বড়।
নির্মল আনন্দ নিয়ে বাঁচুন।
লেখক- মুনির হাসান,সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি
Discussion about this post