হিটলার এ. হালিম
এক দশক আগেও ডাটা সায়েন্স বা ডাটা সায়েন্টিস্ট বলতে কিছু ছিল না। এখন এই শতকের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত চাকরি এটি। এ খাতে রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা এবং মোটা অঙ্কের বেতন। ব্যবসায় প্রচুর পরিমাণে ডাটা বা তথ্যের ব্যবহারের কারণেই বিপ্লব ঘটেছে ডাটা সায়েন্সে।
ডাটা সায়েন্টিস্টের কাজ কী?
ডাটা সায়েন্টিস্টদের কাজ হলো বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। তারপর সেটাকে বিভিন্ন রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গবেষণা করে ব্যবসায় কাজে লাগানোর উপযোগী করে তোলা। এতে ব্যবসা আরও গতিশীল হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি তার গ্রাহকদের কাছে নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে।
এখন মূলত ডাটা সায়েন্স বলতে বিভিন্ন ডিজিটাল উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহকেই বোঝায়। এমনকি ব্যক্তি বিভিন্ন মেসেজিং অ্যাপে যেসব কথাবার্তা বলেন, সেটা থেকেও তথ্য নিয়ে ব্যক্তির প্রয়োজন বুঝে নেয় ডাটা সায়েন্টিস্টদের তৈরি প্রযুক্তি। আবার ব্যক্তির অন্যান্য ডিজিটাল তথ্য (লোকেশন, ছবি, কোথায় বেড়াতে গেলেন) বিশ্লেষণ করেও ডাটা সায়েন্টিস্টরা বুঝে নেন ওই ব্যক্তির বর্তমান চাহিদা কী এবং কোন বিজ্ঞাপনে তিনি সাড়া দেবেন বেশি।
চাহিদা বাড়ছে
বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠানগুলো অভিজ্ঞ ডাটা সায়েন্টিস্ট পাচ্ছে না বলা যায়। কারণ প্রযুক্তি যেভাবে বিকশিত হচ্ছে সেভাবে এই খাতে জনবল গড়ে ওঠেনি। পাশাপাশি বাড়তি বেতনের চাহিদা তো রয়েছেই। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস বলছে, ২০২৬ সালের মধ্যে এই খাতে দক্ষ জনবলের প্রয়োজন বাড়বে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী চাহিদা এতো বেশি যে, দক্ষ ডাটা সায়েন্টিস্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরো খাতেই চাপ তৈরি হয়েছে। অভিজ্ঞ প্রার্থী পেতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওকাডোর ডাটা সায়েন্স বিভাগের প্রধান লিবি কিনসেই বলেন, এটা নতুন খাত। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। এ কারণে নির্দিষ্ট দক্ষতাসম্পন্ন লোক খুঁজে পাওয়া কষ্টের। ওপরের স্তরে (নেতৃত্ব দেওয়ার মতো) জনবল সংকট আরও বেশি।
ডাটা সায়েন্টিস্টদের আয় কেমন?
মার্কিন প্রতিষ্ঠান পেস্কেল-এর তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের নবীন ডাটা সায়েন্টিস্টরা বছরে ৯৭ হাজার ডলার মূল বেতন পান। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৮৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সে হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে ডাটা সায়েন্টিস্টরা বাংলাদেশি মুদ্রায় মাসে প্রায় ৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা আয় করছেন।
অন্যদিকে দেশটির ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত সিনিয়র ডাটা সায়েন্টিস্টরা নবীনদের তুলনায় পাচ্ছেন দ্বিগুণ। ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটাতে কর্মরত ডাটা সায়েন্টিস্টরা বছরে গড়ে ২ লাখ ৬০ হাজার ডলার মূল বেতন পান। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ, সিনিয়র ডাটা সায়েন্টিস্টদের মাসিক আয় প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ টাকা।
ডাটা সায়েন্সের ভবিষ্যত
ডাটা সায়েন্সের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন এ খাতে যুক্ত থাকা বৈশ্বিক বিশ্লেষকরা। বিভিন্ন পূর্বাভাসও তেমনটিই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে ডাটা সায়েন্স প্ল্যাটফর্মের বৈশ্বিক বাজার হবে ৩২২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালে ছিল ৯৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
ডাটা সায়েন্টিস্ট হতে কী যোগ্যতা লাগবে
ডাটা সায়েন্টিস্ট হতে টেকনিক্যাল দক্ষতা তো লাগবেই, পাশাপাশি ভালো যোগাযোগ দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানে পারদর্শী হতে হবে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এয়ারবিএনবি’র কর্মকর্তা লেবার্জ বলেন, ১০ বছর আগে কারিগরিভাবে সক্ষম মানুষ পাওয়া কঠিন ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো এমন প্রার্থী চায় যারা শুধু কারিগরি দিক দিয়েই দক্ষ নয়, বরং তাদের ব্যবসার জ্ঞানও ভালো থাকবে।
বাংলাদেশে ডাটা সায়েন্স
বাংলাদেশে ডাটা সায়েন্স খাত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। অনেক শিক্ষার্থী বিষয়টি নিয়ে পড়তে চাচ্ছেন। কিন্তু উপযুক্ত প্ল্যাটফর্মের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না।
এখন অল্প পরিসরে ডাটা সায়েন্স বিষয়ে পাঠদান এবং বিভিন্ন কোর্স চালু হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ের উপযোগী করে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি এবং উন্নত প্রশিক্ষণ চালুর আহ্বান জানিয়েছেন এ খাতে যুক্ত হতে চাওয়া অনেক শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে ডাটা। শুধু ডাটা খুব বেশি অর্থবহ নয়। ডাটাকে প্রক্রিয়া ও বিশ্লেষণ করে তাৎপর্য বের করে নিয়ে আসতে পারলে তখনই তা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধানে তখন সেটি রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একজন ডাটা সায়েন্টিস্ট ডাটাকে অর্থবোধক করে তোলার সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করে থাকেন। বিশ্বব্যাপী এ খাতের বিশেষজ্ঞদের চাহিদা রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিসংখ্যান, গণিত, প্রোগ্রামিংয়ের মতো বিষয়ের ধারণা যে কারও ডাটা সায়েন্টিস্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। ডাটা সায়েন্সের সঙ্গে শুধু তুলনামূলক জটিল বিশ্লেষণধর্মী কাজই সংশ্লিষ্ট নয়, ডাটা সংরক্ষণও এর বড় একটি অংশ। সফটওয়্যার কিংবা পাইথন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহারের কথা বাদই দিলাম, শুধু মাইক্রোসফট এক্সেল বা এ জাতীয় কোনও সফটওয়্যারে দক্ষতা থাকলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস করে ফেলা সম্ভব।
বাংলাদেশে এর সম্ভাবনার বিষয়ে ড. মইনুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে প্রচুর ব্যবহারকারী থাকায়, প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে ডাটা। হতে পারে সেটি কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ডাটা, গ্রাহকের ডাটা, নাগরিকদের দেওয়া সেবার ডাটা, কিংবা হতে পারে পরিবেশগত পরিবর্তনের ডাটা।
উদাহরণ হিসেবে তিনি অনলাইন কেনাকাটা, ব্যাংক বা আর্থিক লেনদেন, মোবাইল যোগযোগ, সরকারি সেবা ইত্যাদি নানা ধরনের ডাটার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে ডাটার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। নিশ্চিতভাবে ধারণা করা যায়, কিছুদিনের মধ্যে ডাটার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া সিদ্ধান্তই হয়ে উঠবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অন্যতম উপায়। COURTESY- BANGLATRIBUNE
Discussion about this post