এবার চাঁদের বুকে অক্সিজেন তৈরির দিকে ঝুঁকেছেন বিজ্ঞানীরা। গত অক্টোবরে নাসা ও অস্ট্রেলিয়ান স্পেস অ্যাজেন্সি চাঁদে অস্ট্রেলিয়ার তৈরি রোভার পাঠানোর চুক্তি করে। আরতেমিস প্রোগ্রামের আওতায় এ চুক্তি করেছে মহাকাশ সংস্থা দুটি।
কিন্তু সংস্থা দুটির এ নিয়ে ভাবনা কী? কীভাবে অক্সিজেন উৎপাদন হবে? চাঁদের পাথর থেকেই শ্বাসযোগ্য অক্সিজেন তৈরির চিন্তা করছে বিজ্ঞানীরা।
চাঁদের বায়ুমণ্ডল খুবই পাতলা, হাইড্রোজেন নিয়ন আর আরগনের পাতলা একটি স্তর। তবে এই স্তর অক্সিজেন টিকে থাকার মতো বায়বীয় অবস্থায় নেই। চাঁদে অক্সিজেনের পরিমাণ কিন্তু নেহাত কম নয়। তবে এই অক্সিজেন বায়বীয় অবস্থায় নেই। চাঁদের পৃষ্ঠে পাথর ও ধূলোর মধ্যে চাপা পড়ে আছে এই অক্সিজেন। প্রশ্ন হলো, এই অবস্থা থেকে অক্সিজেন নিষ্কাশন করা গেলে কি চাঁদে মানব বসতি গড়ে তোলা যাবে?
আমাদের চারপাশেই অনেক খনিজ পদার্থে অক্সিজেনের অস্তিত্ব আছে। চাঁদও পৃথিবীর মাটি-পাথরের মতো একই রকম পদার্থে তৈরি। তবে উল্কাপিণ্ডের বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি বেশি উপগ্রহটিতে।
চাঁদের পৃষ্ঠে সিলিকা, অ্যালুমিনিয়াম, লোহা ও ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইডের পরিমাণ বেশি। এ সবগুলোতেই অক্সিজেন আছে, কিন্তু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য উপযোগী অবস্থায় নেই। পাথর, ধূলিকণা, নুড়িসহ বিভিন্ন অবস্থায় চাঁদে এসব খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। অসংখ্য বছর ধরে চাঁদের পৃষ্ঠে উল্কাপাতের প্রভাবেই এসব পদার্থের সৃষ্টি।
অক্সিজেন নিষ্কাশন
চাঁদের পৃষ্ঠের আবরণে ৪৫ শতাংশ অক্সিজেন আছে। বিভিন্ন পদার্থের ভেতরে জমে থাকায় সেই অক্সিজেন নিষ্কাশন করতে শক্তির প্রয়োজন।
ইলেকট্রোলাইসিসের মাধ্যমেই এটি সম্ভব, অনেকে হয়তো এ পদ্ধতির নাম শুনে থাকবেন। পৃথিবীতে অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনের জন্যও এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অক্সিজেন থেকে অ্যালুমিনিয়াম আলাদা করতে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের তরলে বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেওয়া দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবেই অক্সিজেন তৈরি হয়। তবে চাঁদে অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষেত্রে অ্যালুমিনিয়াম হবে বাইপ্রোডাক্ট ।
এ পদ্ধতি একেবারেই জটিল কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, এর জন্য প্রচুর পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন। টেকসইভাবে এ প্রক্রিয়া চালাতে চাঁদে সৌরশক্তি বা অন্যান্য শক্তির উৎস প্রয়োজন হবে।
চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে অক্সিজেন উৎপাদন করতে আরও প্রয়োজন হবে টেকসই ইন্ডাস্ট্রিয়াল যন্ত্রপাতি। প্রথমে সলিড মেটাল অক্সাইডকে তরল অবস্থায় রূপান্তর করতে হবে। পৃথিবীতে এ পদ্ধতি চালানোর মতো প্রযুক্তি আছে। এসব যন্ত্রপাতি চাঁদে নিয়ে যাওয়া ও পুরো পদ্ধতির জন্য পর্যাপ্ত শক্তি উৎপাদন করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এ বছরের শুরুতেই বেলজিয়াম ভিত্তিক স্টার্টআপ স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সার্ভিস ঘোষণা দিয়েছিল, ইলেকট্রোলাইসিসের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপাদনের প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে তিনটি রিঅ্যাক্টর তৈরির কাজ করছে তারা। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির এক মিশনের অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে চাঁদে এ প্রযুক্তি পাঠানোর উদ্দেশ্যে কাজ করছে সংস্থাটি।
অক্সিজেনের পরিমাণ
এ তো গেলো পুরো প্রক্রিয়ায় কী চ্যালেঞ্জ আসবে তার কথা। কিন্তু চাঁদে সফলভাবে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা যদি আমরা অর্জন করি, তারপর কী হবে? চাঁদে কী পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন সম্ভব?
চাঁদের পৃষ্ঠের প্রতি কিউবিক মিটারে গড়ে ১.৪ টন খনিজ পদার্থ আছে। এরমধ্যে অক্সিজেনের পরিমাণ ৬৩০ কেজি। নাসা বলছে, বেঁচে থাকতে একজন মানুষের দৈনিক ৮০০ গ্রাম অক্সিজেন দরকার হয়। সে হিসেবে ৬৩০ গ্রাম অক্সিজেন দিয়ে একজন মানুষ দুই বছর বেঁচে থাকতে পারবে।
এখন, চাঁদের পৃষ্ঠের গড় গড় গভীরতা ১০ মিটার ধরে নিলে, আর এ থেকে সব অক্সিজেন নিষ্কাশন সম্ভব হলে, চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে নিষ্কাশিত অক্সিজেন থেকেই ৮০০ কোটি মানুষের এক লাখ বছর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের যোগান দেওয়া সম্ভব হবে!
তবে কতোটা সফলভাবে অক্সিজেন নিষ্কাশন সম্ভব হবে আর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে কি না – এর ওপর নির্ভর করছে আসলেই ৮০০ কোটি মানুষের ১ লাখ বছর বেঁচে থাকার অক্সিজেন পাওয়া যাবে কি না। সে যাই হোক, এর কাছাকাছি সম্ভব হলেও কিন্তু বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ!
সূত্র: স্ক্রল
Discussion about this post